ধর্ষণ কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; রাজনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, প্রশাসন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর উগ্রবাদী অংশের সহায়তায় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ বা নিঃস্ব করার উদ্দেশ্য থাকে, তখন তাদের নারীদের ওপর ধর্ষণকে একটি ‘যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমন-পীড়ন
রাজনৈতিক সহিংসতা বা গৃহযুদ্ধের সময় শত্রু সম্প্রদায়কে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয়। এতে একটি সম্প্রদায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় বা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। যেমন:
- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা বাঙালি নারীকে টার্গেট করেছিল।
- ১৯৯০ এর দশকে বসনিয়ায় মুসলিম নারীদের ওপর সার্ব বাহিনীর গণধর্ষণ অভিযান।
জাতিগত শুদ্ধি ও নির্মূল অভিযানের অংশ
যখন রাষ্ট্রীয় নীতি বা সহায়তায় একটি জাতি বা সম্প্রদায়কে এলাকা থেকে উৎখাত বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তখন তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয় তাদের পরিচয়কে ‘দূষিত’ করার প্রতীকি উদ্দেশ্যে। ধর্ষণ তখন একটি রাজনৈতিক বার্তা হয়ে ওঠে:
- “তোমাদের অস্তিত্ব আমাদের হাতে।”
- “তোমাদের সন্তানরাও হবে আমাদের শাসনের স্মারক।”
রাষ্ট্রীয় ও আইনগত সুরক্ষার অনুপস্থিতি
ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য যখন রাষ্ট্রীয় নীতিতে বৈধতা পায়, তখন সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যায়। তাদের ওপর অপরাধের বিচার হয় না, বা সরকার-সমর্থিত বাহিনীই অপরাধ করে:
সন্ত্রাস সৃষ্টির হাতিয়ার
ধর্ষণ এমন এক অপরাধ যা শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক কলঙ্ক তৈরি করে। এই কলঙ্কিত করার মাধ্যমে পুরো সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত রাখা হয়:
- নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা নষ্ট হয়।
- পরিবারগুলো একে সামাজিক অপমান হিসেবে দেখে, ফলে তারা নিরাপদ এলাকায় পালাতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ
আন্তর্জাতিক আইন ধর্ষণকে এখন যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণকে গণহত্যার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে:
- রুয়ান্ডার গণহত্যা।
- মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ধর্ষণ অভিযান।
রাষ্ট্রে যখন আইন, প্রশাসন ও ক্ষমতা কাঠামো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক হয়ে ওঠে, তখন ধর্ষণ একটি ‘রাষ্ট্রীয় নীতি’ বা ‘যুদ্ধের কৌশল’ হয়ে যায়। এর উদ্দেশ্য শুধু নারীদেহ দখল নয়, পুরো সম্প্রদায়ের মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো ধ্বংস করা। রাষ্ট্রীয় মদদে বা রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় সংঘটিত এ ধরনের সংগঠিত ধর্ষণ মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং ইতিহাসে বহুবার ঘটে গেছে—যা বিশ্বকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও ন্যায়বিচার কতটা গুরুত্বপূর্ণ।