০৫:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মিষ্টি হাসির রূপকথা

শৈশবের আলোছায়া

১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেন মিনা পাল। কে জানত এই শান্তশিষ্ট মেয়েটিই একদিন পর্দা কাঁপানো কবরী হয়ে উঠবেন? পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনস্ক, প্রতিদিন গানের সুর, নাচের তাল–লয়, কবিতার ছন্দে বোনা। ছোট্ট মিনা মঞ্চে নাচতেন, গান শিখতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন।

তখনকার রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের সিনেমায় আসা মানে তুমুল সমালোচনা, ফিসফিসে কুৎসা। কিন্তু পরিবারের আংশিক সমর্থন আর নিজের একরোখা সাহস তাকে আলাদা করে দিল সহপাঠিনীদের থেকে। পর্দার ঝলকানি, স্টুডিওর আলো তার কিশোর মনকে টানত।

প্রথম আলোর ঝলক – ‘সুতরাং

মাত্র ১৩ বছর বয়সে জীবনের বাঁক ঘুরে গেল। কিংবদন্তি নির্মাতা সুভাষ দত্তের হাতে “মিনা পাল” হয়ে উঠলেন “কবরী”। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেল ‘সুতরাং’। সাদা-কালো পর্দায় এক ঝলক হাসি, স্বাভাবিক অভিনয়, নিষ্পাপ সরলতা—দর্শক মুগ্ধ।

‘সুতরাং’ কেবল সিনেমা নয়, একটা যুগের সূচনা। পর্দায় কবরীর হাসি যেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের নারীর সম্ভাবনা আর সাহসের প্রতীক হয়ে উঠল। রক্ষণশীল সমাজে এক কিশোরীর অভিনয় করাটাই ছিল সাহসের চূড়ান্ত নিদর্শন।

তারকা হয়ে ওঠার গল্প

‘সুতরাং’–এর পর আর থামেননি কবরী। একের পর এক সাফল্যের গল্প লিখেছেন তিনি—

  • বহ্নিশিখা (১৯৬৯)
  • অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
  • সোনালী আঁশ (১৯৭৩)
  • রঙ্গবাজ (১৯৭৩)
  • আলোর মিছিল (১৯৭৪)
  • দীপ নেভে নাই
  • বাহানা
  • সারেং বৌ (১৯৭৮)
  • মধুমতি (১৯৭৯)
  • অবাক পৃথিবী (১৯৮১)

ঢাকাই সিনেমার রোমান্টিক জুটি বলতে রাজ্জাক–কবরীর নামটাই তখন প্রথম মনে পড়ত। তাদের রসায়ন ছিল মধুর, সহজ, জীবন্ত। দর্শকরা বলতেন—‘‘রোমান্টিক মানেই রাজ্জাক–কবরী!’’

বৈচিত্র্যের অভিনেত্রী

কবরীর ক্যারিয়ার কেবল রোমান্সে থেমে থাকেনি। ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ বা ‘আলোর মিছিল’–এর মতো ছবিতে তিনি সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন।

সবচেয়ে আলোচিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে নদীর মাঝির স্ত্রীর চরিত্রে তার অভিনয় আজও কিংবদন্তি। একজন গ্রামের সাদাসিধে নারী থেকে শহুরে প্রলোভনের মুখোমুখি হওয়া—সমাজের চোখ রাঙানি—সব কিছু কবরী ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনবদ্য বাস্তবতায়। তার চোখের ভাষা, সংলাপের টান—সবই যেন তখনকার নারীর মনের কথা।

পরিচালক কবরী: নারীর চোখে সমাজ

শুধু অভিনয়েই নয়, সিনেমা পরিচালনাতেও কবরী নিজেকে প্রমাণ করেন। ২০০৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘আয়না’।

‘আয়না’তে তিনি তুলে ধরেন নারীর আত্মপরিচয়, সম্পর্কের জটিলতা, সমাজের রূঢ় বাস্তবতা। এর গল্প বলে, কবরীর দৃষ্টি কেবল গ্ল্যামার বা বিনোদনের জন্য নয়—তিনি চেয়েছিলেন সমাজকে প্রশ্ন করতে, নারীর কণ্ঠকে জোর দিতে।

রাজনীতি ও সমাজচিন্তা

২০০৮ সালে কবরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তার আলোচনার বিষয়গুলো ছিল স্পষ্ট: নারী অধিকার, শিল্পীর মর্যাদা, সংস্কৃতির সংরক্ষণ।

একজন সাংসদ হিসেবেও তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, সংস্কৃতিমনা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তার অবদান স্মরণীয়।

 

ব্যক্তিজীবনের হাসি-কান্না

কবরীর ব্যক্তিজীবন সিনেমার মতো সহজ ছিল না। বিয়ে করেছিলেন সহঅভিনেতা শামীম চৌধুরীকে। সেই সংসার টেকেনি। তাদের একমাত্র ছেলে শাকের চিশতী বিদেশে থাকেন।

একবার কবরী বলেছিলেন:

‘‘মানুষ আমাকে মিষ্টি মেয়ে ভাবলেও, আমার জীবনে নোনাজলও কম ছিল না।’’

এই একটি বাক্যেই লুকিয়ে আছে তার জীবনের সৎ স্বীকারোক্তি, মানুষের মতো মানুষের সারল্য।

সম্মাননা ও স্বীকৃতি

সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকসহ বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার, বাচসাস সম্মাননা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার স্বীকৃতি—সবই কবরীর জীবনের ঝুলিতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান?
দেশের মানুষের ভালোবাসা।
তাকে বলা হতো “মিষ্টি মেয়ের হাসি”—এক হাসি যা কখনো মলিন হয়নি।

শেষ দৃশ্য – বিদায়

২০২১ সালের এপ্রিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৭ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবরী।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক অঙ্গন—সবাই শোকবার্তা দিলেন। সংবাদপত্রের শিরোনাম বলল—

“শেষ হয়ে গেল মিষ্টি হাসির রূপকথা।”

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র হারাল এক অভিভাবককে।

উত্তরাধিকার – কেন কবরী অমর?

কবরী মানে শুধু একজন অভিনেত্রী নয়, এক যুগের নাম। সেই যুগে নারীরা পর্দায় আসত ভয় নিয়ে, সমাজের বাঁকা নজর সয়ে। কবরী সেই ভয়কে হাসিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।

তিনি ছিলেন রোল মডেল—যিনি শিখিয়েছেন কিভাবে অভিনয়ে জীবন্ততা আনতে হয়, শিল্পে সমাজ–চিন্তা ঢোকাতে হয়, সততা ধরে রাখতে হয়।

কবরী সারোয়ার ছিলেন এক অনন্য রত্ন। অভিনেত্রী, পরিচালক, সংসদ সদস্য, নারী–অধিকারকর্মী—সব পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন এক সত্যিকারের শিল্পী।

বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসে তার অবদান অমলিন থাকবে চিরকাল। নতুন প্রজন্ম যখনই শিখবে অভিনয়ের কথা, কবরীর হাসি, তার সহজাত অভিনয়, তার মানবিক স্পর্শ—সবই থাকবে তাদের পথের আলো হয়ে।

মিষ্টি হাসির রূপকথা

১০:০০:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

শৈশবের আলোছায়া

১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেন মিনা পাল। কে জানত এই শান্তশিষ্ট মেয়েটিই একদিন পর্দা কাঁপানো কবরী হয়ে উঠবেন? পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনস্ক, প্রতিদিন গানের সুর, নাচের তাল–লয়, কবিতার ছন্দে বোনা। ছোট্ট মিনা মঞ্চে নাচতেন, গান শিখতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন।

তখনকার রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের সিনেমায় আসা মানে তুমুল সমালোচনা, ফিসফিসে কুৎসা। কিন্তু পরিবারের আংশিক সমর্থন আর নিজের একরোখা সাহস তাকে আলাদা করে দিল সহপাঠিনীদের থেকে। পর্দার ঝলকানি, স্টুডিওর আলো তার কিশোর মনকে টানত।

প্রথম আলোর ঝলক – ‘সুতরাং

মাত্র ১৩ বছর বয়সে জীবনের বাঁক ঘুরে গেল। কিংবদন্তি নির্মাতা সুভাষ দত্তের হাতে “মিনা পাল” হয়ে উঠলেন “কবরী”। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পেল ‘সুতরাং’। সাদা-কালো পর্দায় এক ঝলক হাসি, স্বাভাবিক অভিনয়, নিষ্পাপ সরলতা—দর্শক মুগ্ধ।

‘সুতরাং’ কেবল সিনেমা নয়, একটা যুগের সূচনা। পর্দায় কবরীর হাসি যেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের নারীর সম্ভাবনা আর সাহসের প্রতীক হয়ে উঠল। রক্ষণশীল সমাজে এক কিশোরীর অভিনয় করাটাই ছিল সাহসের চূড়ান্ত নিদর্শন।

তারকা হয়ে ওঠার গল্প

‘সুতরাং’–এর পর আর থামেননি কবরী। একের পর এক সাফল্যের গল্প লিখেছেন তিনি—

  • বহ্নিশিখা (১৯৬৯)
  • অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)
  • সোনালী আঁশ (১৯৭৩)
  • রঙ্গবাজ (১৯৭৩)
  • আলোর মিছিল (১৯৭৪)
  • দীপ নেভে নাই
  • বাহানা
  • সারেং বৌ (১৯৭৮)
  • মধুমতি (১৯৭৯)
  • অবাক পৃথিবী (১৯৮১)

ঢাকাই সিনেমার রোমান্টিক জুটি বলতে রাজ্জাক–কবরীর নামটাই তখন প্রথম মনে পড়ত। তাদের রসায়ন ছিল মধুর, সহজ, জীবন্ত। দর্শকরা বলতেন—‘‘রোমান্টিক মানেই রাজ্জাক–কবরী!’’

বৈচিত্র্যের অভিনেত্রী

কবরীর ক্যারিয়ার কেবল রোমান্সে থেমে থাকেনি। ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ বা ‘আলোর মিছিল’–এর মতো ছবিতে তিনি সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন।

সবচেয়ে আলোচিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে নদীর মাঝির স্ত্রীর চরিত্রে তার অভিনয় আজও কিংবদন্তি। একজন গ্রামের সাদাসিধে নারী থেকে শহুরে প্রলোভনের মুখোমুখি হওয়া—সমাজের চোখ রাঙানি—সব কিছু কবরী ফুটিয়ে তুলেছিলেন অনবদ্য বাস্তবতায়। তার চোখের ভাষা, সংলাপের টান—সবই যেন তখনকার নারীর মনের কথা।

পরিচালক কবরী: নারীর চোখে সমাজ

শুধু অভিনয়েই নয়, সিনেমা পরিচালনাতেও কবরী নিজেকে প্রমাণ করেন। ২০০৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘আয়না’।

‘আয়না’তে তিনি তুলে ধরেন নারীর আত্মপরিচয়, সম্পর্কের জটিলতা, সমাজের রূঢ় বাস্তবতা। এর গল্প বলে, কবরীর দৃষ্টি কেবল গ্ল্যামার বা বিনোদনের জন্য নয়—তিনি চেয়েছিলেন সমাজকে প্রশ্ন করতে, নারীর কণ্ঠকে জোর দিতে।

রাজনীতি ও সমাজচিন্তা

২০০৮ সালে কবরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তার আলোচনার বিষয়গুলো ছিল স্পষ্ট: নারী অধিকার, শিল্পীর মর্যাদা, সংস্কৃতির সংরক্ষণ।

একজন সাংসদ হিসেবেও তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, সংস্কৃতিমনা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তার অবদান স্মরণীয়।

 

ব্যক্তিজীবনের হাসি-কান্না

কবরীর ব্যক্তিজীবন সিনেমার মতো সহজ ছিল না। বিয়ে করেছিলেন সহঅভিনেতা শামীম চৌধুরীকে। সেই সংসার টেকেনি। তাদের একমাত্র ছেলে শাকের চিশতী বিদেশে থাকেন।

একবার কবরী বলেছিলেন:

‘‘মানুষ আমাকে মিষ্টি মেয়ে ভাবলেও, আমার জীবনে নোনাজলও কম ছিল না।’’

এই একটি বাক্যেই লুকিয়ে আছে তার জীবনের সৎ স্বীকারোক্তি, মানুষের মতো মানুষের সারল্য।

সম্মাননা ও স্বীকৃতি

সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকসহ বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার, বাচসাস সম্মাননা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার স্বীকৃতি—সবই কবরীর জীবনের ঝুলিতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সম্মান?
দেশের মানুষের ভালোবাসা।
তাকে বলা হতো “মিষ্টি মেয়ের হাসি”—এক হাসি যা কখনো মলিন হয়নি।

শেষ দৃশ্য – বিদায়

২০২১ সালের এপ্রিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ১৭ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবরী।

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক অঙ্গন—সবাই শোকবার্তা দিলেন। সংবাদপত্রের শিরোনাম বলল—

“শেষ হয়ে গেল মিষ্টি হাসির রূপকথা।”

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র হারাল এক অভিভাবককে।

উত্তরাধিকার – কেন কবরী অমর?

কবরী মানে শুধু একজন অভিনেত্রী নয়, এক যুগের নাম। সেই যুগে নারীরা পর্দায় আসত ভয় নিয়ে, সমাজের বাঁকা নজর সয়ে। কবরী সেই ভয়কে হাসিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।

তিনি ছিলেন রোল মডেল—যিনি শিখিয়েছেন কিভাবে অভিনয়ে জীবন্ততা আনতে হয়, শিল্পে সমাজ–চিন্তা ঢোকাতে হয়, সততা ধরে রাখতে হয়।

কবরী সারোয়ার ছিলেন এক অনন্য রত্ন। অভিনেত্রী, পরিচালক, সংসদ সদস্য, নারী–অধিকারকর্মী—সব পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন এক সত্যিকারের শিল্পী।

বাংলাদেশের সিনেমা ইতিহাসে তার অবদান অমলিন থাকবে চিরকাল। নতুন প্রজন্ম যখনই শিখবে অভিনয়ের কথা, কবরীর হাসি, তার সহজাত অভিনয়, তার মানবিক স্পর্শ—সবই থাকবে তাদের পথের আলো হয়ে।