রেস্টুরেন্টে বিড়াল কানওয়ালা রোবট
টোকিওর শিনজুকুর পারিবারিক রেস্টুরেন্ট গাস্তোতে ঢুকলেই চোখে পড়ে ছোটখাটো এক রোবট, যার মাথায় বিড়ালের কান আর পর্দায় হাসিমুখের ডিজিটাল বিড়ালচেহারা। বাচ্চার সমান উচ্চতার এই রোবট ধীরে ধীরে চওড়া করিডোর দিয়ে খাবার নিয়ে যায়, কাস্টমারদের স্টেক-প্যানকেকের টেবিলে পৌঁছে দেয়।
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জাপান ঘুরতে আসা ১০ বছর বয়সী গিয়ন মো প্রথমে একটু ভয় পেলেও মজা পেল এই রোবটের আইসক্রিম পরিবেশনায়। রোবটটি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে কাস্টমারের টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার অর্ডার-ন্যান!”, যা জাপানি পপ কালচারের বিড়াল চরিত্রের ঢঙে বলা।
এই বেলাবট নামের রোবট বানিয়েছে চীনা কোম্পানি পুডু রোবোটিক্স। জাপানের বড় রেস্টুরেন্ট চেইন স্কাইলার্ক হোল্ডিংস এ ধরনের প্রায় ৩,০০০ রোবট ব্যবহার করছে, যা ওয়েটারদের হাঁটার দূরত্ব ৪২% কমিয়ে দিয়েছে। এতে কাজের পরিবেশ সহজ হয়ে যাওয়ায় সপ্তাহান্তের ব্যস্ত সময়ে পার্টটাইম কর্মী নিয়োগও সহজ হয়েছে।
সহজ সেবা রোবটের চাহিদা বাড়ছে
আইসক্রিম দেওয়া বিড়াল রোবট হয়তো চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এআই-চালিত হিউম্যানয়েড রোবটের মতো উচ্চ প্রযুক্তির মনে না হলেও এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক বাস্তবতা। টোকিওর ফুজি কেইজাই রিসার্চ সংস্থা অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে জাপানের সেবা রোবট বাজার দ্বিগুণ হয়ে ৪০০ বিলিয়ন ইয়েনে পৌঁছাবে। অন্যদিকে শিল্পখাতে রোবটের বাজার ২০৬ বিলিয়ন ইয়েনে সীমিত থাকবে।
উত্তর জাপানের মিয়াগি প্রিফেকচারে অবস্থিত ইরিস ওহয়ামা কোম্পানি অনুমান করছে, তাদের অফিস-ক্লিনিং রোবট ব্যবসা ২০২৭ সালে ১০০ বিলিয়ন ইয়েন আয়ে পৌঁছাবে। এর বড় কারণ জাপানের শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান সংকট।
ইরিস ওহয়ামার রোবোটিক্স বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার ইউতাকা ইয়োশিদা বলেন, জাপানে ভবন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সস্তা ও প্রবীণ শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে চলেছে। এখন সকাল ৭টা থেকে ৯টার মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদেশি শ্রমিকও সস্তা সমাধান নয়, কারণ ইয়েন দুর্বল হওয়ায় ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কারণে বিদেশি শ্রমিক পাওয়া কঠিন।
খাবার শিল্পের জন্য সাশ্রয়ী রোবট
ক্লোজার নামের একটি জাপানি স্টার্টআপ সাশ্রয়ী ও সহজে ব্যবহারযোগ্য শিল্প রোবট তৈরি করছে বিশেষ করে খাবার শিল্পের জন্য। সাধারণ শিল্প রোবটের প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার (PLC) ভিত্তিক কোড কম জটিল হলেও খুব বেশি নমনীয় নয়। ক্লোজারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শোটা হিগুচি বললেন, গাড়ি শিল্পের মতো অটোমেশনের অভিজ্ঞতা খাবার শিল্পে কম, এবং কারখানার জায়গাও ছোট হওয়ায় বড় রোবট বসানো কঠিন।
ক্লোজারের রোবট Python এবং C++ এর মতো জনপ্রিয় কোড ব্যবহার করে দ্রুত এআইসহ নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করতে পারে। যেমন সাইতামা প্রিফেকচারের এক বেন্টো ফ্যাক্টরিতে তাদের রোবট নুডলসের সসের নরম প্যাকেট তোলার কাজ করছে। এটি বাজারের সাধারণ রোবটের অর্ধেক দামে এবং দ্বিগুণ গতিতে কাজ করছে।
তাদের হাতে এখন কিছু অর্ডার রয়েছে, যা ২০২৮ সালের মধ্যে কয়েক শত ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা।
হিউম্যানয়েড রোবটের দৌড়ে পিছিয়ে জাপান
বিড়াল কানওয়ালা ওয়েটার বা সস প্যাকেট ধরার রোবট যতই আকর্ষণীয় হোক, জাপান এখন চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো হিউম্যানয়েড রোবট প্রতিযোগিতায় নেই। চীনের স্টার্টআপগুলো যেমন ইউনিট্রি, ইউবিটেক বা ডোবট শারীরিকভাবে দক্ষ রোবট বানিয়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছে। চীনের লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে হিউম্যানয়েড রোবটের গণ উৎপাদন শুরু করে ২০৩৫ সালে এটি ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার করা।
এদিকে BYD, Xiaomi, Huawei এআই রোবট উন্নয়নে লগ্নি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেসলা এআই চিপ ও সফটওয়্যারে এগিয়ে আছে।
১৯৯০-২০০০ দশকে জাপান হিউম্যানয়েড রোবট তৈরির পথিকৃৎ হলেও এখন এআই সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপান অন্তত পাঁচ বছর পিছিয়ে আছে।
হিউম্যানয়েড রোবটের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ
সবাই অবশ্য এটাকে খারাপ দেখছে না। সফটব্যাংক রোবোটিক্সের চিফ মার্কেটিং অফিসার কাজুতাকা হাসুমি বলেন, রোবটের নকশা মানুষসদৃশ করা খুব বেশি কার্যকর নয়। শিল্প রোবটের কাজ স্পষ্ট— ভারী কিছু তোলা বা স্ক্রু লাগানো। হিউম্যানয়েড রোবটের মানবীয় গঠন সাধারণ ব্যবহার উপযোগী হলেও নির্দিষ্ট কোনো কাজে মানুষের চেয়ে ভালো হওয়ার লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে।
তিনি মনে করেন, একদিন হিউম্যানয়েড রোবট লাভজনক হবে, তবে এখনকার বাস্তবতায় এ ধরনের রোবট ব্যয়বহুল, পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয় এবং চার্জিং সুবিধাও সীমিত।
হাসুমির কথায়, সফটব্যাংকের পেপার রোবট ২০১৫ সালে বাজারে এলেও খুব বড় সাফল্য পায়নি। পেপার বা অন্য হিউম্যানয়েড রোবট এখনো ক্লাসরুম, দোকান বা গ্রুপ এক্সারসাইজের মতো সীমিত ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর বিক্রি সহজ নয় কারণ এগুলোর স্পষ্ট লক্ষ্যবস্তু বাজার নেই।
ভবিষ্যৎ চাহিদা ও বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ
কেপিএমজি কনসাল্টিংয়ের মোতোউ সাতো বলেন, জাপানের বৃদ্ধ ও কমতে থাকা জনসংখ্যা ভবিষ্যতে উন্নত রোবটের চাহিদা তৈরি করবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কখন এবং কোন মানের রোবট কোন বাজারে ছড়িয়ে পড়বে। তার মতে, হিউম্যানয়েড রোবট গাড়ির দামের সমান হওয়া পর্যন্ত অন্তত এক দশক লাগবে, তখন বিনিয়োগকারীরা লাভ তুলতে পারবে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এআই রোবট নিয়ে সাম্প্রতিক আগ্রহের উৎস চিপ ইন্ডাস্ট্রি। এআই ডেটা সেন্টারের জন্য চিপের চাহিদা কমে যেতে পারে, তাই রোবট হতে পারে পরবর্তী বড় বাজার।
জাপানের শ্রম দক্ষতা ও রোবট ব্যবসার বাস্তবতা
জাপানের শ্রম দক্ষতা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ঘণ্টাপ্রতি উৎপাদনশীলতা ছিল ৫৮%। এর কারণ ছোট-মাঝারি ব্যবসার আধিক্য এবং সামগ্রিক ডিজিটালাইজেশনের ঘাটতি।
ইরিস ওহয়ামার ইয়োশিদা বললেন, রোবট ব্যবসা শুরু করা সহজ নয়। কোম্পানিটি ২০০০ সাল থেকে রোবট তৈরি করছে। কাস্টম ডিজাইন, দীর্ঘমেয়াদি ট্রায়াল এবং দ্রুত রিপ্লেসমেন্ট সুবিধা দিতে গিয়ে খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদি মুনাফার লক্ষ্য নিয়ে বাজারে ঢোকা কঠিন।
স্কাইলার্কও রোবট ওয়েটার বসাতে প্রথমে কষ্ট করেছে। একদল “রোবট ইনস্ট্রাক্টর” রেস্টুরেন্টে গিয়ে গতি ও কাজের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করত, দরকার হলে পরিবর্তন আনত। নতুন রেস্টুরেন্টগুলোতে করিডোরও চওড়া করা হয়েছে যেন রোবট সহজে চলতে পারে।
একজন মুখপাত্রের ভাষায়, “রোবট সব সমস্যার সমাধান নয়। শুধু ফেলে রাখলেই সফলতা আসবে না।”