বিশ্বের অধিকাংশ বিরল মাটি (রেয়ার আর্থ) ধাতু—এবং কিছু বিশেষ ধরনের ধাতুর প্রায় পুরোটা—চীনের খনি ও পরিশোধনকারখানায় উৎপাদিত হয়। এতে বাণিজ্য-শৃঙ্খলে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও দেশটিকে দীর্ঘকাল ধরে ভয়াবহ পরিবেশগত ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
চীনের আধিপত্য কীভাবে গড়ে উঠল
উত্তরাঞ্চলীয় বাউতোউ শহর ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বিপুল খনি ও পরিশোধনকাজ চালিয়ে চীন বিশ্ববাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জন করে।
১৯৯০-এর দশকেই শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো কঠোর পরিবেশমানদণ্ডের কারণে নিজ নিজ বিরল মাটি শিল্প গুটিয়ে নেয়; চীন সে সুযোগে উৎপাদন বাড়ায়।
বাউতোউ: দূষণের কেন্দ্রবিন্দু
গবি মরুভূমির দক্ষিণ প্রান্তে দুই মিলিয়ন বাসিন্দার সমতল নগরী বাউতোউ নিজেকে ‘বিশ্বের বিরল মাটির রাজধানী’ বলে দাবি করে।
শহরের উত্তর প্রান্তে ১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কৃত্রিম কাদা-হ্রদ ‘ওয়েইকুয়াং ড্যাম’—যেখানে কয়েক দশক ধরে খনিজ উত্তোলনের বিষাক্ত বর্জ্য জমা হয়েছে।
শীত-বসন্তে কাদা শুকিয়ে ধুলোর ঝড় ওঠে; এতে সিসা, ক্যাডমিয়াম ও তেজস্ক্রিয় থোরিয়াম মিশে বাতাসে ছড়ায়। বর্ষায় বিষাক্ত পানি মাটিতে মিশে ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত করে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক দাম
শিশুদের বুদ্ধিবিকাশ-বিষয়ক ব্যাধি, পশুখাদ্যের ঘাটতি ও প্রাণী-মৃত্যুর প্রমাণ—সবই বিরল মাটি শিল্পের দূষণের সঙ্গে যুক্ত।
২০০৯-এর সরকারি প্রতিবেদন ও পরবর্তী গবেষণাগুলোতে বাউতোউ ও আশপাশে থোরিয়াম-যুক্ত ধুলো, বিষাক্ত স্ল্যাগ ও বর্জ্যজলের উৎস্রাবণ উল্লেখ করা হয়।
শাসন, মালিকানা ও স্বার্থদ্বন্দ্ব
পরিবেশ তদারকি মূলত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ইনার মঙ্গোলিয়া সরকার দেখে, আবার তারাই বাওগাং গ্রুপের মালিক—যে প্রতিষ্ঠান বায়ান অবো খনি ও বেশির ভাগ পরিশোধনকারখানা চালায়।
এই দ্বৈত ভূমিকাই কঠোর মনিটরিংকে জটিল করেছে। সাংবাদিকেরা তথ্য সংগ্রহে গেলে পুলিশ ও কোম্পানির নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দেন এবং ‘ব্যবসায়িক গোপনীয়তা’র কথা তুলে ধরেন।
পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
২০১০-১১ সালে অবৈধ খনি বন্ধে অভিযান, ২০১৫-তে বর্জ্যপ্রস্তুতির ঘোষণা ও হ্রদপাড়ে পাথরের বাঁধ-মজবুতি—সবই আংশিক অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়।
তা সত্ত্বেও বিপুল কাদা-হ্রদে এখনো কোনো জলরোধী আস্তরণ নেই; মরু-হাওয়ায় ধুলো উড়ে বেড়ানো রোধ করাও কঠিন।
দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলীয় লংনান এলাকায় ‘হেভি’ বিরল মাটি উত্তোলন হলেও ছোট ছোট খনির পাশের ঝরনায় রংচঙে, বুদবুদে দূষণ ফুটে ওঠে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য ও কূটনীতি
বায়ান অবো খনি থেকে তেল পরিশোধনে ব্যবহৃত ল্যান্থানাম ও সামরিক প্রযুক্তির সামারিয়ামসহ বিপুল ‘লাইট’ ও ‘মিডিয়াম’ বিরল মাটি উৎপন্ন হয়।
সাম্প্রতিক বাণিজ্য টানাপোড়েনে চীন সামারিয়াম রপ্তানি স্থগিত এবং ‘হেভি’ বিরল মাটি রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে—যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য চাপ তৈরি করেছে।
তথ্যদমন ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
এক দশক আগেও হাজার একর চারণভূমি বন্ধ করে দেওয়া ও পশুমৃত্যু নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন ছাপলেও বর্তমানে সেই তথ্য অনলাইনে প্রায় অদৃশ্য।
বর্জ্য নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ এবং স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা—সবই চীনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
বিরল মাটি ধাতুতে চীনের অপরিসীম নিয়ন্ত্রণ বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খলে শক্তি জুগিয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে দেশের নদী-খাল, জমি, বায়ু ও মানুষের স্বাস্থ্য চড়া মূল্য দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সংস্কার প্রচেষ্টা কিছুটা স্বস্তি দিলেও বিশাল কাদা-হ্রদ, তেজস্ক্রিয় ধুলো ও দূষিত ঝরনা ইঙ্গিত দেয়—পরিবেশগত দায় শোধের লড়াইটি এখনও সুদূরপ্রসারী।