বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন পর্যটন খ্যাত হলেও সেখানকার মানুষের জীবনের বাস্তবতা ভিন্ন। পর্যটক টানতে প্রচুর প্রচার-প্রচারণা হলেও দ্বীপবাসীর মৌলিক সেবা—বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা—বছরের পর বছর উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বর্তমানে দ্বীপে কোনো পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নেই। সম্প্রতি সরকারের সিদ্ধান্তে গত ১০ মাস ধরে দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দাদের নতুনভাবে বসতি গড়া বা পরিবারসহ স্থায়ীভাবে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেন্ট মার্টিনের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অচল হয়ে গেছে।
হাসপাতাল ও চিকিৎসা সুবিধার অনুপস্থিতি
দ্বীপে কোনো সরকার অনুমোদিত হাসপাতাল নেই। আগে একটি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প থাকলেও সেটি পর্যাপ্ত ছিল না। সেন্ট মার্টিনের প্রায় ১০ হাজার অধিবাসীর জন্য নেই কোনো চিকিৎসক, নেই নার্স, নেই কোনো পর্যাপ্ত ওষুধের দোকান। জ্বর, ডায়রিয়া, আঘাত, গর্ভকালীন জটিলতা বা হৃদরোগের মতো প্রাথমিক সমস্যাগুলোও বড় বিপদে পরিণত হয়।
জরুরি রোগী পরিবহন ও সমুদ্রযাত্রার ঝুঁকি
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, জরুরি রোগীকে কক্সবাজার বা টেকনাফে নিয়ে যেতে সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়। রাতে বা খারাপ আবহাওয়ায় কোনো নৌযান চলে না। এর অর্থ, রাতে হঠাৎ জটিল অসুস্থতা হলে রোগীর জন্য কার্যত কোনো চিকিৎসা নেই। অনেক সময় রোগী নৌকায় বা ট্রলারে যাওয়ার পথেই মারা যায়।
সরকারি নীতির পরিবর্তন ও মানুষের দুর্ভোগ
গত ১০ মাসে পরিবেশ সুরক্ষার নামে সরকারের কঠোর নীতিতে স্থায়ী বসবাসকারীদের পরিবারসহ সেন্ট মার্টিনে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। অনেককে মূল ভূখণ্ডে চলে যেতে হয়েছে, কিন্তু দ্বীপে যারা মাছধরা বা পর্যটন সেবা দিয়ে জীবিকা চালায়, তারা থেকে গেছে। সরকারি নীতি দ্বীপে নতুন অবকাঠামো নির্মাণেও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে। ফলে কেউ ব্যক্তিগত চেষ্টায় হাসপাতাল বা ক্লিনিক করতেও পারছে না।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা পরিকল্পনার অভাব
সরকারি নীতিতে পরিবেশ রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলেও দ্বীপবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। কোনো নৌ-অ্যাম্বুলেন্স নেই, নেই নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প বা ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল।
ভুক্তভোগীদের অভিমত
দ্বীপবাসীর অভিযোগ, “আমাদের জন্য কোনো ডাক্তার নেই, ছোট রোগও বড় হয়ে যায়। বাচ্চারা ডায়রিয়ায় কষ্ট পায়, নারীরা সন্তান প্রসবের সময় বিপদে পড়ে।” স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বলেন, “সরকার আমাদের এখানে থাকতে দিচ্ছে না ঠিক মতো, কিন্তু বিকল্প কোনো ব্যবস্থা দিচ্ছে না।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সেন্ট মার্টিনের মতো পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা না থাকা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। পরিবেশ সুরক্ষা মানেই মানুষের জীবন-সুরক্ষা বাদ দিয়ে চলা যায় না। সমন্বিত পরিকল্পনায় পরিবেশ রক্ষার সাথে সাথে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উচিত।
সম্ভাব্য সমাধান
১. ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম নিয়মিত দ্বীপে পাঠানো।
২. নৌ-অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু করা।
৩. মৌলিক ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৪. সরকারি অনুমোদনে ছোট সোলার-চালিত ক্লিনিক বা চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি।
৫. স্থানীয় জনগণকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ।
বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন আয়ের উৎস সেন্ট মার্টিন। কিন্তু পর্যটকদের স্বস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে দ্বীপবাসীর মৌলিক অধিকার ভুলে যাওয়া এক বড় বৈপরীত্য। স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া কোনো জনগোষ্ঠী টিকে থাকতে পারে না। তাই দ্বীপ রক্ষার নীতির সাথে সাথে দ্বীপবাসীর স্বাস্থ্য রক্ষার নীতি এখন সময়ের দাবি।