১১:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

মংলা নদী: দুই শতকের ইতিহাস, বাণিজ্য, সভ্যতা আর সংস্কৃতির জলছাপ

নদীর পরিচয় ও ভৌগোলিক অবস্থান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী মংলা। এটি পশুর নদীর একটি শাখা। নদীটি খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সীমান্তে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটে চলে। সুন্দরবনের নিকটবর্তী এই নদী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বাণিজ্যিক গুরুত্বে অনন্য।

দুই শত বছরের ইতিহাস: ব্রিটিশ আমল থেকে আজ

মংলা নদীর ইতিহাস প্রায় দুই শত বছর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ শাসনকালে এটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৮শ শতকের শেষ ভাগ আর ১৯শ শতকের শুরুতে যখন কলকাতা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়, তখন এই অঞ্চলে নতুন নৌপথ খোঁজা হয়। পশুর নদী আর মংলা নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা বিদেশি জাহাজকে সহজে ভিড়তে দিত। এতে ভারতের কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে ছাড়াও বার্মা, সিলোন (শ্রীলঙ্কা), মালয় উপদ্বীপের সঙ্গে রপ্তানি-আমদানির রাস্তা তৈরি হয়।

ব্রিটিশ আমলে বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচল

তৎকালীন বাণিজ্যের বড় অংশ ছিল পাট, চাল, মাছ, নীল, কাঠ, লবণ এবং হাতিশিকল, ম্যানগ্রোভ কাঠ ও মোম। মংলা নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে গুদামঘর, শুল্ককেন্দ্র আর নৌযান মেরামতের ছোট ডকইয়ার্ড। স্থানীয় নাও-ডিঙ্গি, কাঠের বড় মালগাড়ি নৌকা এবং বাষ্পচালিত জাহাজ এ নদীতে চলত। রাত হলে জাহাজের আলোয় নদীর দুই পাড় আলোকিত হয়ে যেত—এ যেন এক জলভিত্তিক বাণিজ্য-নগরীর চেহারা।

পাকিস্তান আমল: নতুন রপ্তানি সম্ভাবনা

১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান আমলে মংলা নদী এবং এর বন্দর গুরুত্ব পায় পূর্ব বাংলার রপ্তানি-কেন্দ্র হিসেবে। তৎকালীন সরকার পশ্চিম পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাট, চাল, মাছ রপ্তানির জন্য মংলা নদীকে ব্যবহার করে। মংলা বন্দর প্রকল্পও তখন পরিকল্পিত হয়। সরকারি কাগজপত্রে দেখা যায়, মংলা নদীর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সুন্দরবনের কাঠ, মোম, মাছ এবং নদী-নির্ভর বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করত।

বাংলাদেশের আমলে আধুনিক বন্দর

স্বাধীনতার পর মংলা নদী এবং বন্দর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। ১৯৫০-এর দশকের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় ১৯৫৪ সালে মংলা বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়ে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে এটি পরিচিত। বন্দর ব্যবহার করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশের সঙ্গে পণ্য আদান-প্রদান হয়। দেশীয় শহর—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ইত্যাদির সঙ্গে নৌপথে ও সড়কপথে যুক্ত হয় এই নদী।

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল

মংলা নদীতে দেশি বড় কার্গো জাহাজ, বিদেশি কন্টেইনার শিপ, বাল্ক ক্যারিয়ার নোঙর করে। ভারত, নেপাল, ভুটানের পণ্যও এই বন্দর দিয়ে যাতায়াত করে। ১৯ শতক থেকে আজ পর্যন্ত হাজারো দেশি-বিদেশি জাহাজ এখানে নোঙর করে, পণ্য ওঠা-নামা করে। রাতের বেলা জাহাজের বাতিতে মংলা নদীর দুই পাড় ঝলমল করে। এ আলোকছটা নদীপাড়ের মানুষের স্মৃতিতে বন্দর-শহরের রোমাঞ্চ জাগায়।

দুই পাড়ের সভ্যতা ও জীবিকা

মংলা নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে বন্দরনির্ভর জনপদ। এখানকার মানুষ নৌকা চালানো, মাঝি-মাল্লার কাজ, লোডিং-আনলোডিং, জাহাজের কুলির কাজ, কাস্টমস হ্যান্ডলিং—এ সব পেশায় যুক্ত। অনেকেই ছোট ব্যবসা চালায় বন্দরকেন্দ্রিক বাজারে। নদীর মাছও জীবিকার বড় অংশ—ইলিশ, চিংড়ি, পারশে, কৈ, শোল, বাইনসহ নানান প্রজাতির মাছ ধরা হয়। সুন্দরবনের ঘেঁষা হওয়ায় এখানকার জীবিকা ম্যানগ্রোভ কাঠ, মোম, মধু এবং মাছের ওপর নির্ভরশীল।

সুন্দরবনের সান্নিধ্য

মংলা নদী সুন্দরবনের একদম কাছে। নদীর বুক দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ সুন্দরবনের চ্যানেল পেরিয়ে সমুদ্রগামী হয়। নদীর পানি মিষ্টি-লোনা মিশ্রণ হওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এখানকার নৌপথ রক্ষা করে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে আঘাত কমায়। সুন্দরবনের সৌন্দর্য নদীর যাত্রীদের বিমোহিত করে।

সাহিত্যসংস্কৃতি ও গান

মংলা নদী শুধু বাণিজ্য নয়—সংস্কৃতিরও অংশ। নদীর দুই পাড়ের লোকসংগীতে নদীর নাম ধ্বনিত হয়। মাঝি-মাল্লার গান, ভাটিয়ালি, সারি গান—সবাই মংলার জলে জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনা করে। স্থানীয় কবি-গীতিকাররা নদীর ঢেউ, জাহাজের আলো, সুন্দরবনের রহস্যময় বন নিয়ে গান রচনা করেছেন। নদীর তীরের মেলা, নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ।

মংলা নদী শুধু একটি নদী নয়—বাংলাদেশের দুই শত বছরের বাণিজ্যিক ইতিহাস, উপকূলীয় সভ্যতা, জীবিকা, নৌ-যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সুন্দরবনের জৈববৈচিত্র্য, এবং লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। নদীর বুক জুড়ে চলে জীবনের নৌযাত্রা—যা আজও বহমান।

মংলা নদী: দুই শতকের ইতিহাস, বাণিজ্য, সভ্যতা আর সংস্কৃতির জলছাপ

০৭:০০:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

নদীর পরিচয় ও ভৌগোলিক অবস্থান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী মংলা। এটি পশুর নদীর একটি শাখা। নদীটি খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সীমান্তে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটে চলে। সুন্দরবনের নিকটবর্তী এই নদী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বাণিজ্যিক গুরুত্বে অনন্য।

দুই শত বছরের ইতিহাস: ব্রিটিশ আমল থেকে আজ

মংলা নদীর ইতিহাস প্রায় দুই শত বছর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ শাসনকালে এটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৮শ শতকের শেষ ভাগ আর ১৯শ শতকের শুরুতে যখন কলকাতা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়, তখন এই অঞ্চলে নতুন নৌপথ খোঁজা হয়। পশুর নদী আর মংলা নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা বিদেশি জাহাজকে সহজে ভিড়তে দিত। এতে ভারতের কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে ছাড়াও বার্মা, সিলোন (শ্রীলঙ্কা), মালয় উপদ্বীপের সঙ্গে রপ্তানি-আমদানির রাস্তা তৈরি হয়।

ব্রিটিশ আমলে বাণিজ্য ও জাহাজ চলাচল

তৎকালীন বাণিজ্যের বড় অংশ ছিল পাট, চাল, মাছ, নীল, কাঠ, লবণ এবং হাতিশিকল, ম্যানগ্রোভ কাঠ ও মোম। মংলা নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে গুদামঘর, শুল্ককেন্দ্র আর নৌযান মেরামতের ছোট ডকইয়ার্ড। স্থানীয় নাও-ডিঙ্গি, কাঠের বড় মালগাড়ি নৌকা এবং বাষ্পচালিত জাহাজ এ নদীতে চলত। রাত হলে জাহাজের আলোয় নদীর দুই পাড় আলোকিত হয়ে যেত—এ যেন এক জলভিত্তিক বাণিজ্য-নগরীর চেহারা।

পাকিস্তান আমল: নতুন রপ্তানি সম্ভাবনা

১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান আমলে মংলা নদী এবং এর বন্দর গুরুত্ব পায় পূর্ব বাংলার রপ্তানি-কেন্দ্র হিসেবে। তৎকালীন সরকার পশ্চিম পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাট, চাল, মাছ রপ্তানির জন্য মংলা নদীকে ব্যবহার করে। মংলা বন্দর প্রকল্পও তখন পরিকল্পিত হয়। সরকারি কাগজপত্রে দেখা যায়, মংলা নদীর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সুন্দরবনের কাঠ, মোম, মাছ এবং নদী-নির্ভর বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করত।

বাংলাদেশের আমলে আধুনিক বন্দর

স্বাধীনতার পর মংলা নদী এবং বন্দর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। ১৯৫০-এর দশকের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় ১৯৫৪ সালে মংলা বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়ে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে এটি পরিচিত। বন্দর ব্যবহার করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশের সঙ্গে পণ্য আদান-প্রদান হয়। দেশীয় শহর—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ইত্যাদির সঙ্গে নৌপথে ও সড়কপথে যুক্ত হয় এই নদী।

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল

মংলা নদীতে দেশি বড় কার্গো জাহাজ, বিদেশি কন্টেইনার শিপ, বাল্ক ক্যারিয়ার নোঙর করে। ভারত, নেপাল, ভুটানের পণ্যও এই বন্দর দিয়ে যাতায়াত করে। ১৯ শতক থেকে আজ পর্যন্ত হাজারো দেশি-বিদেশি জাহাজ এখানে নোঙর করে, পণ্য ওঠা-নামা করে। রাতের বেলা জাহাজের বাতিতে মংলা নদীর দুই পাড় ঝলমল করে। এ আলোকছটা নদীপাড়ের মানুষের স্মৃতিতে বন্দর-শহরের রোমাঞ্চ জাগায়।

দুই পাড়ের সভ্যতা ও জীবিকা

মংলা নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে বন্দরনির্ভর জনপদ। এখানকার মানুষ নৌকা চালানো, মাঝি-মাল্লার কাজ, লোডিং-আনলোডিং, জাহাজের কুলির কাজ, কাস্টমস হ্যান্ডলিং—এ সব পেশায় যুক্ত। অনেকেই ছোট ব্যবসা চালায় বন্দরকেন্দ্রিক বাজারে। নদীর মাছও জীবিকার বড় অংশ—ইলিশ, চিংড়ি, পারশে, কৈ, শোল, বাইনসহ নানান প্রজাতির মাছ ধরা হয়। সুন্দরবনের ঘেঁষা হওয়ায় এখানকার জীবিকা ম্যানগ্রোভ কাঠ, মোম, মধু এবং মাছের ওপর নির্ভরশীল।

সুন্দরবনের সান্নিধ্য

মংলা নদী সুন্দরবনের একদম কাছে। নদীর বুক দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ সুন্দরবনের চ্যানেল পেরিয়ে সমুদ্রগামী হয়। নদীর পানি মিষ্টি-লোনা মিশ্রণ হওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এখানকার নৌপথ রক্ষা করে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে আঘাত কমায়। সুন্দরবনের সৌন্দর্য নদীর যাত্রীদের বিমোহিত করে।

সাহিত্যসংস্কৃতি ও গান

মংলা নদী শুধু বাণিজ্য নয়—সংস্কৃতিরও অংশ। নদীর দুই পাড়ের লোকসংগীতে নদীর নাম ধ্বনিত হয়। মাঝি-মাল্লার গান, ভাটিয়ালি, সারি গান—সবাই মংলার জলে জীবনের সুখ-দুঃখ বর্ণনা করে। স্থানীয় কবি-গীতিকাররা নদীর ঢেউ, জাহাজের আলো, সুন্দরবনের রহস্যময় বন নিয়ে গান রচনা করেছেন। নদীর তীরের মেলা, নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ।

মংলা নদী শুধু একটি নদী নয়—বাংলাদেশের দুই শত বছরের বাণিজ্যিক ইতিহাস, উপকূলীয় সভ্যতা, জীবিকা, নৌ-যোগাযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, সুন্দরবনের জৈববৈচিত্র্য, এবং লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। নদীর বুক জুড়ে চলে জীবনের নৌযাত্রা—যা আজও বহমান।