০২:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

দুধে-ভাতের সন্তান

  • মণীশ রায়
  • ১০:০০:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
  • 8
মন্মথপুরের হোসনে আরাকে এখন আর চেনা যায় না।
এ প্রসঙ্গ এলে এলাকার অলস ও অকর্মণ্য লোকজন আজকাল চায়ে চুমুক দিয়ে চুকচুক করে আফসোসের শব্দ তুলে মন্তব্য ঝাড়ে,’ এর নাম কফাল। কী মাইয়াডা কিতা অইয়া গেলগা। আহারে!’
অথচ এককালে কী মিষ্টি আর মায়াময় ছিল হোসনে আরার ফুটফুটে চেহারাখানা! কলেজে যাওয়ার পথে তৃষ্ণার্ত যুবকের দল ওকে একঝলক দেখার আশায় ওৎ পেতে থাকত রাস্তার কিনারে।
এসব দেখেশুনে সন্দেহপ্রবণ মুহুরি বাবা মাসুম সাহেব উঠে-পড়ে লেগে গেলেন পাত্র যোগাড় করতে। এলাকার এক মোক্তারের ছেলের সঙ্গে পাকা কথা প্রায় হয়-হয় অবস্থা। আপন সাফল্যে একেবারে আনন্দে ডগমগ তখন মাসুম সাহেব।
ঠিক সেসময় স্থানীয় মাস্তান হাসান ওদের বাড়ির উঠোনে দিনে-দুপুরে পটকা ফুটিয়ে হোসনে আরাকে তুলে নিয়ে গেল চোখের নিমেষে। থানা পুলিশ উকিল মোক্তার কোনকিছুতেই আর কাজ হল না।
কলিজার টুকরো মেয়েটা এজলাশে উঠে জজকে নিষ্ঠুর গলায় বলল,’ এই লোক আমার বাপ না। আমার শত্রু। আমি সজ্ঞানে ভালবেসে হাসান জোয়ার্দারকে স্বামী হিসাবে বরণ করে নিয়েছি। আমি সাবালিকা।’
পলকের ভেতর মাসুম মুহুরি সবার সামনে খলনায়ক বনে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন প্রিয় কোর্ট-চত্ত্বর ছেড়ে। তারপর আর কোনদিন সেদিকে পা মাড়াননি। মুহুরিগিরি ছেড়ে দিয়ে নির্বাক নিষ্প্রাণ জীবন কাটালেন কদিন। তারপর একদিন স্ট্রোক হয়ে দুম করে মরেও গেলেন মানুষটা।
হোসনে আরা তখন হাসানের তুমুল ভালোবাসায় মগ্ন। হাসান ওকে কেবল আকাশের তারা দেখাচ্ছে। আব্বার মৃত্যুর খবর শুনে হোসনে আরা মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন শত্রুপক্ষের কেউ নিকেশ হয়েছে, এমনি ওর ভাব। সে তখন আকাশের তারা গোনায় ব্যস্ত। তিন ভাইয়ের একটাই বোন এই হোসনে আরা। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ভাইয়েরা কদিন ঘুরে গেছে বোনের শ্বশুরবাড়ি। দেখা হয়নি। রিকশায় গেলে দশ মিনিট আর হাঁটাপথে সর্বসাকুল্যে বিশ মিনিট লাগে হাসানদের বাড়ি পৌঁছুতে। মন্মথপুরে সবাই এ বাড়িটি এড়িয়ে চলে। সবাই ভয় পায় পরিবারটিকে।
তবু উঠতি ব্যবসায়ী তিনভাই একেসঙ্গে দই-মিষ্টি নিয়ে বোনকে নিজেদের বাড়িতে নাইয়রী হিসাবে নেবার জন্য প্রায়ই উপস্থিত হতো। দেখা মিলত না বোনের, তবু। হাসান ওদের সঙ্গে কথা বলত না। চোখমুখ কুঁচকে ওদের সামনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত।
এরকম একদিন দীর্ঘ অপেক্ষার পর হোসনে আরা বের হয়ে কর্কশ কণ্ঠে উত্তর দিল,’ রোজ রোজ আইসা অত বইসা থাক কেরে? যারা আমার স্বামীরে গ্রহণ করতে পারে নাই, তারা আমার শত্রু। আমার কাছে তারা মৃত। তাদের আমি চিনি না। আপনারা আর আইবেন না। চলে যান।’
‘তরে বাড়িত নিবার লাইগাই তো আইছি হুসনি। আম্মার শরীলডাও বালা না। খালি তরে দেখবার চায়। না থাহস, একবার আম্মারে দেইখ্যা যা বইন।’ কাতর গলায় অনুরোধ জানায় ভাইয়েরা।
‘তুমরা কি যাইবা না জামাইর হাতের মাইর-মুরা খাইতে চাও?’ বলে হোসনে আরা আর দাঁড়ায় না। ভেতরে চলে যায়।
বাড়ি ফেরার পর শয্যাশায়ী অসুস্থ আমেনা বেগম ছেলেদের জিজ্ঞাসা করেন,’ মাইয়াডার চেহারাডা বড় দেখবার মন চায়। তাই
বালা আছে নি রে?’ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে করুণ অসহায় চোখে প্রশ্ন করেন তিনি।
‘হুসনি খুব সুখে আছে আম্মা। আমরা দেইখ্যা আইছি। খালি আমরারে ভুইলা গেছে।’
‘আল্লাহ তাইরে শান্তি দিক, সুখি হউক তাই।’ বলে দুচোখের জল ছেড়ে দিলেন আমেনা বেগম। সরু ক্ষীণ দুই হাত তুলে মেয়ের জন্য দোয়া পড়তে থাকেন। এ দৃশ্য সহ্য করতে পারে না ভাইয়েরা। অন্য ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয় ওরা। চোখের সামনে ভাসে আদরের ছোট বোন হোসনে আরার চেহারা।
সেই রুক্ষ্ম নিষ্ঠুর মেয়েটির পুরো চেহারা জুড়ে এখন কালো ছাপ। জোনাক-জ্বলা যে চোখ দেখে একদা পাগল হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় গুন্ডা হাসান জোয়ার্দার, সেই চোখে আর তারা জ্বলে না। নিষ্প্রভ এই দৃষ্টিপ্রদীপে চোখ রেখে হাসান যখন তখন বিরক্ত হয়। রেগে গিয়ে হম্বিতম্বি করে। চুলের মুঠি ধরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘তোরে দেখলেই আমার নাপাক জাগার কথা মনে আয়ে কেরে? মনে হয় হারারাত ধইরা চাবকাই, ক. কেরে?’
হোসনে আরা ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর বোধবুদ্ধিগুলো লোপ পেয়েছে বহু আগে। মাটির ঢেলার মতো ওর আচরণ স্থির ও অনুভবহীন।
প্রথম দিকে হাসানের অবহেলা-অত্যাচার ওকে কাঁদালেও এখন সব ডালভাত। শুরুতে একতরফা মার খাওয়ার সময় নখ দিয়ে খামচে ধরত স্বামীকে। চোখের জল ফেলত অবিরাম। এখন সেসব আর নেই। গাছের মতো, বাতাসের মতো, মাটির মতো সয়ে যাচ্ছে হাসানকে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ওর মাথায় বাপের বাড়ি নেই। মা-বাবার মুখ কবেই ভুলে বসে রয়েছে।
ভাইয়েরা উঠোনের উটকো গাছ হয়ে গেছে, কোন যোগাযোগ নেই। শুধু দুটো চেহারাই ওর কাছে সবকিছু হাসান আর ওর একমাত্র সন্তান অদম্য হাসান। ঘুমের ভেতরও মাঝে মাঝে মনে হয়, ওরা দুজন মিলে ওকে খাটের সঙ্গে শক্ত করে চেপে রেখেছে : নাকেমুখের নিশ্বাস আটকে রেখে ওরা যেন বলতে থাকে, নাক ডাকে ক্যা? নাক ডাকে ক্যা?’
হোসনেআরার শ্বাশুড়ি আরও এক কাঠি উপরে। সে যেদিন স্বামীর হাতে মার খেত, সেদিন তিনি আনন্দে একেবারে গদগদ। স্ট্রোকে চলৎশক্তিহীন অথর্ব তোশারফ আলীর কাছে এসে হাত-পা নেড়ে মন্তব্য করতেন,’পোলাডা অক্করে আমার মতন। হুতায়া দিছে মুহুরির বেজন্মা বেডিটারে।’
একসময় থানা নির্বাহী কর্মকর্তার টাইপিস্ট হিসাবে কাজ করতেন তোশারফ। মাসুম মুহুরি ওর চেনাজানা মানুষ। তাই খানিক বাঁধ- বাঁধ লাগে মারধরের এসব দৃশ্য। তাছাড়া, বুড়ো বয়সে রক্ত ঠাণ্ডা হবার পর এগুলো ভালোও লাগে না আর আগের মতো।
অস্পষ্ট গলায় বলে ওঠেন,’ মাইয়াডা লাডির বাড়ি খাইয়া তো মইরা যাইবো আমেনা বিবি?’
‘বিলাইর আড্ডি তাইর। কেরে, তুমার হাতে যে কত চড়-থাপ্পড় আর লোহার শিকের বাড়ি খাইছি, আমি মইরা গেছি? বেজন্মার ঝিও মরত না।’
‘দম গেলেগা কৈলাম কেইস হবো বাদাইম্যার ঝি। মনে রাহিছ।’ অতিকষ্টে কথাগুলো বলে তোশারফ নিষ্কৃতি খোঁজেন বিবেকের কাছে।
‘কুস্তা অইতো না। পুষ্যালোকের মাইরা না খাইলে বেডিআইতের শরীল ঠিক থাহে না। চুপ থাক। মজা দ্যাখ।’ মুখ ভেংচে উত্তর দেন তিনি।
একটু বাদে আমেনা বিবি মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ছেলেকে উৎসাহ যুগিয়ে বলে ওঠে,’ মাগির হাত-পাওডি ভাইঙ্গা দে। আর কুনদিন য্যান লড়াচড়া না করতে পারে।’ বলে ছেলের হাত থেকে ভাঙা লাঠিটি নিজের কাছে নিয়ে নতুন লাঠি এগিয়ে দেয় ছেলের হাতে।
হোসনে আরার ক্ষীণ একটা সাধ ছিল ছেলে অদম্য বড় হয়ে ওর কষ্ট ঘোচাবে। ওর ঢাল হয়ে ওকে সকল অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে।
কিন্তু অদম্য বড় হয়ে বাপের চেয়ে আরও একধাপ খ্যাপাটে ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। লেখাপড়ার ধার ধারেনি। বাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় শহরময়। সুদে টাকা খাটায়। টাকা দিতে দেরি হলে দেনাদারের সঙ্গে গুন্ডামি করে বাপে-পুতে মিলে। মাত্র পাঁচহাজারের জন্য ঘরের টেলিভিশন-ফ্রিজ সব বের করে নিয়ে নিজ বাড়িতে তোলে। সবাই ভয়ে-ত্রাসে কাঁপে। দুতিনবার জেলহাজতও খেটেছে। পুলিশের মার খেয়ে খেয়ে শরীর নীল হয়ে গেছে। তবু হোসনে আরার শ্বাশুড়ির সোহাগ মরে না। বউর কাছে বসে মন্তব্য ঝাড়ে,’ পুষ্যালোক মিউ মিউ করলে বিলাই বিলাই লাগে। গায়ের জোর না থাকলে কি কেউ মানে, কও?’
এখন মাথার উপর শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ নেই। শাশুড়ি বাজ খেয়ে মরেছে তেঁতুল গাছতলায়। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শরীর। শ্বশুর পানি-পানি করে খাট থেকে পড়ে সেখানেই দমটা গেছে। স্বামী হাসানের দুবার স্ট্রোক হয়ে মরণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। চেয়ারে বসে এককাত হয়ে শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করতে থাকে। হোসনে আরা ছাড়া ওর কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। কথা বলার সময় অবিরাম থুতু ঝরে মুখ থেকে। তবু এখনও সামান্য এদিক-সেদিক হলে ওর গায়ে হাত তুলতে চায় অথর্ব স্বামী। চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে সে।
হোসনে আরা এককালে এই মূর্খ যণ্ডা লোকটারই প্রেমে মজেছিল। সুখের পাখি ওড়াতে চেয়েছিল আকাশে। এত মারধর খেয়েও ছেলেটার নাম রেখেছিল অদম্য। এইচএসসি পাস হোসনে আরা ভেবেছিল, ছেলেটা অদ্ভুত কিছু একটা হয়ে অন্ধকার মৃত্যুপুরীতে মশাল জ্বালাবে। কিন্তু সে-ও কবেই বাপের হাতে খুন হয়ে গেছে। এখন হোসনে আরা চোখের সামনে অন্য কেউ নয়, নির্দয়-নিষ্ঠুর স্বামীটারই ছায়া দেখতে পায় ছেলের মাঝে।
চোখে ছানি পরার পরও হোসনে আরা অদম্যর কথা ভেবে ঘোলা চোখ থেকে জল ঝরিয়েছে। কোন কাজে দেয়নি মায়ের সেই অশ্রু। বরং কোন বিরূপ কথা বললেই মারমুখী ছেলে তেড়ে আসে ওর দিকে, বুড়নি, বেশি বকবক করবি তো দাও দিয়া দুই টুকরা কইরা ফ্যালামু।’ একদিন তো এমন চড় মেরেছিল ওর গালে যে তিনদিন তব্দা খেয়ে থাকতে হল ওর। এসবে অভ্যস্ত সে। নতুন করে কোন মানে তৈরি করে না।
এখন ছেলের জন্যও মন আর কাঁদে না। শুধু সুযোগ পেলে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,’ দুনিয়াদারি অনেক দেখছি। এইবার আমারে লও।’
যেদিন অদম্যকে পুলিশের দল টানতে টানতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে ওঠাল সেদিনও শুষ্ক ঘোলা চোখে অস্পষ্ট আকাশকে
বলেছিল,’ আমারে লও। রহম কর খোদা।
সবাই বলল, ‘পোলারে বাঁচাইতে অইলে উকিল ধর।’
কিছু বলল না হোসনে আরা। হাজতে গিয়ে অদম্যকে প্রশ্ন করল,’ মাইয়াডিরে পিটাইলি কেরে?’
‘মাইয়াডা খারাপ পোশাক পরছিল। তুমারে কইতে পারুম না।’ ভদ্র ঠাণ্ডা গলায় জানাল।
‘তবু ক একবার। হুনি?’
‘নডি বেডিয়াইতের লাহান ডেরেস। লঞ্চঘাডে গিয়া টিকটক মারাইতেছে। একটা পুরা বাঁশ ভাংছি মাগির শরীরে। আরও দুইডা বান্ধবি আছিল। হিডিরেও হুতাই দিছি পিটাইতে পিটইতে। লাজ থাকলে আর জিন্দিগিতেও নডির পোশাক পইরা বাইর অইত না। ‘আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর কন্ঠ। যেন জীবনের সবচাইতে মহৎ কাজটা করে ফেলেছে সে।
হোসনে আরা কুঁজো শরীর নিয়ে একদৃষ্টে ছেলেকে দেখতে থাকে। হাসান জোয়ার্দারকেই সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। কোন কথা না বলে সে বাড়ি ফিরে আসে। ওর বাবার বাড়ির সামনে দিয়েই আসতে-যেতে হয় ওকে। রিক্সার হুড তুলে দিয়ে দম খিঁচে জায়গাটা পার হয় সে। মনে হয় বিশাল একটা পাহাড় পাড়ি দিচ্ছে সে। তবু কেন যেন মনে হয়, চল্লিশ বছর আগের আমগাছটা এখনও যেন ওকে চিনতে পারে। রাস্তার কিনার ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছটা ঠিক ওর মায়ের গলায় ডেকে ওঠে, আম্মা গো, একবার আয়। দেখে যা আমরারে।’ ভাবতেই হোসনে আরার শরীর শিউরে ওঠে। চোখ বুজে আসে তীব্র এক লজ্জায়।
বাড়ি ফিরে হাসান জোয়ার্দারকে অদম্য সম্পর্কে সব খুলে বলে সে। শুনে অথর্ব বুড়োর চোখমুখ জ্বল-জ্বল করে ওঠে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় গর্ব মিশিয়ে বলে,’ জাতিলা পুলা আমার। আম্মা দেখলে যে কী খুশি অইতো। উকিল দিয়া ছাড়াইয়া আন মাগি। বাপের পুলা।’
হোসনে আরার চোখ দুটো নিষ্ঠুর পাথর হয়ে যায়। অনুচ্চ কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘না।’
সঙ্গে সঙ্গে হাসান একদলা থুতু ছিটিয়ে দেয় ওকে তাক করে। যে-চেয়ারে নড়াচড়াহীন অবশ শরীরটি নিয়ে বসেছিল সেখান থেকে প্রচণ্ড রাগে ওর থরথরে হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারে হোসনে আরার দিকে।
হোসনে আরা নিরব দৃষ্টিতে আরও একবার দেখে নেয় স্বামীর এই চিরচেনা উন্মত্ত চেহারাটি। কোন কথা বলে না। শুধু মনে মনে বলে,’ আইজ তোরে ঘরে নিতাম না। হারা রাইত তুই বাইরে থাকবি। খাওন পাইতি না। ঘুমাইতে পারতি না। আমি খাইয়া- লইয়া নাক ডাইকা ঘুমামু।’ হোসনে আরা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। প্রচুর হেসে নেয় মনে মনে। জানালার শিক ধরে বলে ওঠে,’
আইজ থেইক্যা তুই আমার বউ। আমি জামাই।’ বলে প্রাণের সুখে পুনরায় হেসে ওঠে। একসময় হাসিটা কান্নায় পরিণত হয়। চোখের সামনে আব্বার অপমানিত করুণ চেহারা ভাসে। মৃত্যুর সময়ও কি আব্বার চোখের সামনে একমাত্র কন্যার নিষ্পাপ চেহারাটা ভেসে উঠেছিল? আম্মার বেলায়ও তাই হয়েছিল?
আজকাল এসব যে খুব জানতে চায় মন!

দুধে-ভাতের সন্তান

১০:০০:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
মন্মথপুরের হোসনে আরাকে এখন আর চেনা যায় না।
এ প্রসঙ্গ এলে এলাকার অলস ও অকর্মণ্য লোকজন আজকাল চায়ে চুমুক দিয়ে চুকচুক করে আফসোসের শব্দ তুলে মন্তব্য ঝাড়ে,’ এর নাম কফাল। কী মাইয়াডা কিতা অইয়া গেলগা। আহারে!’
অথচ এককালে কী মিষ্টি আর মায়াময় ছিল হোসনে আরার ফুটফুটে চেহারাখানা! কলেজে যাওয়ার পথে তৃষ্ণার্ত যুবকের দল ওকে একঝলক দেখার আশায় ওৎ পেতে থাকত রাস্তার কিনারে।
এসব দেখেশুনে সন্দেহপ্রবণ মুহুরি বাবা মাসুম সাহেব উঠে-পড়ে লেগে গেলেন পাত্র যোগাড় করতে। এলাকার এক মোক্তারের ছেলের সঙ্গে পাকা কথা প্রায় হয়-হয় অবস্থা। আপন সাফল্যে একেবারে আনন্দে ডগমগ তখন মাসুম সাহেব।
ঠিক সেসময় স্থানীয় মাস্তান হাসান ওদের বাড়ির উঠোনে দিনে-দুপুরে পটকা ফুটিয়ে হোসনে আরাকে তুলে নিয়ে গেল চোখের নিমেষে। থানা পুলিশ উকিল মোক্তার কোনকিছুতেই আর কাজ হল না।
কলিজার টুকরো মেয়েটা এজলাশে উঠে জজকে নিষ্ঠুর গলায় বলল,’ এই লোক আমার বাপ না। আমার শত্রু। আমি সজ্ঞানে ভালবেসে হাসান জোয়ার্দারকে স্বামী হিসাবে বরণ করে নিয়েছি। আমি সাবালিকা।’
পলকের ভেতর মাসুম মুহুরি সবার সামনে খলনায়ক বনে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন প্রিয় কোর্ট-চত্ত্বর ছেড়ে। তারপর আর কোনদিন সেদিকে পা মাড়াননি। মুহুরিগিরি ছেড়ে দিয়ে নির্বাক নিষ্প্রাণ জীবন কাটালেন কদিন। তারপর একদিন স্ট্রোক হয়ে দুম করে মরেও গেলেন মানুষটা।
হোসনে আরা তখন হাসানের তুমুল ভালোবাসায় মগ্ন। হাসান ওকে কেবল আকাশের তারা দেখাচ্ছে। আব্বার মৃত্যুর খবর শুনে হোসনে আরা মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন শত্রুপক্ষের কেউ নিকেশ হয়েছে, এমনি ওর ভাব। সে তখন আকাশের তারা গোনায় ব্যস্ত। তিন ভাইয়ের একটাই বোন এই হোসনে আরা। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ভাইয়েরা কদিন ঘুরে গেছে বোনের শ্বশুরবাড়ি। দেখা হয়নি। রিকশায় গেলে দশ মিনিট আর হাঁটাপথে সর্বসাকুল্যে বিশ মিনিট লাগে হাসানদের বাড়ি পৌঁছুতে। মন্মথপুরে সবাই এ বাড়িটি এড়িয়ে চলে। সবাই ভয় পায় পরিবারটিকে।
তবু উঠতি ব্যবসায়ী তিনভাই একেসঙ্গে দই-মিষ্টি নিয়ে বোনকে নিজেদের বাড়িতে নাইয়রী হিসাবে নেবার জন্য প্রায়ই উপস্থিত হতো। দেখা মিলত না বোনের, তবু। হাসান ওদের সঙ্গে কথা বলত না। চোখমুখ কুঁচকে ওদের সামনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত।
এরকম একদিন দীর্ঘ অপেক্ষার পর হোসনে আরা বের হয়ে কর্কশ কণ্ঠে উত্তর দিল,’ রোজ রোজ আইসা অত বইসা থাক কেরে? যারা আমার স্বামীরে গ্রহণ করতে পারে নাই, তারা আমার শত্রু। আমার কাছে তারা মৃত। তাদের আমি চিনি না। আপনারা আর আইবেন না। চলে যান।’
‘তরে বাড়িত নিবার লাইগাই তো আইছি হুসনি। আম্মার শরীলডাও বালা না। খালি তরে দেখবার চায়। না থাহস, একবার আম্মারে দেইখ্যা যা বইন।’ কাতর গলায় অনুরোধ জানায় ভাইয়েরা।
‘তুমরা কি যাইবা না জামাইর হাতের মাইর-মুরা খাইতে চাও?’ বলে হোসনে আরা আর দাঁড়ায় না। ভেতরে চলে যায়।
বাড়ি ফেরার পর শয্যাশায়ী অসুস্থ আমেনা বেগম ছেলেদের জিজ্ঞাসা করেন,’ মাইয়াডার চেহারাডা বড় দেখবার মন চায়। তাই
বালা আছে নি রে?’ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে করুণ অসহায় চোখে প্রশ্ন করেন তিনি।
‘হুসনি খুব সুখে আছে আম্মা। আমরা দেইখ্যা আইছি। খালি আমরারে ভুইলা গেছে।’
‘আল্লাহ তাইরে শান্তি দিক, সুখি হউক তাই।’ বলে দুচোখের জল ছেড়ে দিলেন আমেনা বেগম। সরু ক্ষীণ দুই হাত তুলে মেয়ের জন্য দোয়া পড়তে থাকেন। এ দৃশ্য সহ্য করতে পারে না ভাইয়েরা। অন্য ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয় ওরা। চোখের সামনে ভাসে আদরের ছোট বোন হোসনে আরার চেহারা।
সেই রুক্ষ্ম নিষ্ঠুর মেয়েটির পুরো চেহারা জুড়ে এখন কালো ছাপ। জোনাক-জ্বলা যে চোখ দেখে একদা পাগল হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় গুন্ডা হাসান জোয়ার্দার, সেই চোখে আর তারা জ্বলে না। নিষ্প্রভ এই দৃষ্টিপ্রদীপে চোখ রেখে হাসান যখন তখন বিরক্ত হয়। রেগে গিয়ে হম্বিতম্বি করে। চুলের মুঠি ধরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘তোরে দেখলেই আমার নাপাক জাগার কথা মনে আয়ে কেরে? মনে হয় হারারাত ধইরা চাবকাই, ক. কেরে?’
হোসনে আরা ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর বোধবুদ্ধিগুলো লোপ পেয়েছে বহু আগে। মাটির ঢেলার মতো ওর আচরণ স্থির ও অনুভবহীন।
প্রথম দিকে হাসানের অবহেলা-অত্যাচার ওকে কাঁদালেও এখন সব ডালভাত। শুরুতে একতরফা মার খাওয়ার সময় নখ দিয়ে খামচে ধরত স্বামীকে। চোখের জল ফেলত অবিরাম। এখন সেসব আর নেই। গাছের মতো, বাতাসের মতো, মাটির মতো সয়ে যাচ্ছে হাসানকে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ওর মাথায় বাপের বাড়ি নেই। মা-বাবার মুখ কবেই ভুলে বসে রয়েছে।
ভাইয়েরা উঠোনের উটকো গাছ হয়ে গেছে, কোন যোগাযোগ নেই। শুধু দুটো চেহারাই ওর কাছে সবকিছু হাসান আর ওর একমাত্র সন্তান অদম্য হাসান। ঘুমের ভেতরও মাঝে মাঝে মনে হয়, ওরা দুজন মিলে ওকে খাটের সঙ্গে শক্ত করে চেপে রেখেছে : নাকেমুখের নিশ্বাস আটকে রেখে ওরা যেন বলতে থাকে, নাক ডাকে ক্যা? নাক ডাকে ক্যা?’
হোসনেআরার শ্বাশুড়ি আরও এক কাঠি উপরে। সে যেদিন স্বামীর হাতে মার খেত, সেদিন তিনি আনন্দে একেবারে গদগদ। স্ট্রোকে চলৎশক্তিহীন অথর্ব তোশারফ আলীর কাছে এসে হাত-পা নেড়ে মন্তব্য করতেন,’পোলাডা অক্করে আমার মতন। হুতায়া দিছে মুহুরির বেজন্মা বেডিটারে।’
একসময় থানা নির্বাহী কর্মকর্তার টাইপিস্ট হিসাবে কাজ করতেন তোশারফ। মাসুম মুহুরি ওর চেনাজানা মানুষ। তাই খানিক বাঁধ- বাঁধ লাগে মারধরের এসব দৃশ্য। তাছাড়া, বুড়ো বয়সে রক্ত ঠাণ্ডা হবার পর এগুলো ভালোও লাগে না আর আগের মতো।
অস্পষ্ট গলায় বলে ওঠেন,’ মাইয়াডা লাডির বাড়ি খাইয়া তো মইরা যাইবো আমেনা বিবি?’
‘বিলাইর আড্ডি তাইর। কেরে, তুমার হাতে যে কত চড়-থাপ্পড় আর লোহার শিকের বাড়ি খাইছি, আমি মইরা গেছি? বেজন্মার ঝিও মরত না।’
‘দম গেলেগা কৈলাম কেইস হবো বাদাইম্যার ঝি। মনে রাহিছ।’ অতিকষ্টে কথাগুলো বলে তোশারফ নিষ্কৃতি খোঁজেন বিবেকের কাছে।
‘কুস্তা অইতো না। পুষ্যালোকের মাইরা না খাইলে বেডিআইতের শরীল ঠিক থাহে না। চুপ থাক। মজা দ্যাখ।’ মুখ ভেংচে উত্তর দেন তিনি।
একটু বাদে আমেনা বিবি মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ছেলেকে উৎসাহ যুগিয়ে বলে ওঠে,’ মাগির হাত-পাওডি ভাইঙ্গা দে। আর কুনদিন য্যান লড়াচড়া না করতে পারে।’ বলে ছেলের হাত থেকে ভাঙা লাঠিটি নিজের কাছে নিয়ে নতুন লাঠি এগিয়ে দেয় ছেলের হাতে।
হোসনে আরার ক্ষীণ একটা সাধ ছিল ছেলে অদম্য বড় হয়ে ওর কষ্ট ঘোচাবে। ওর ঢাল হয়ে ওকে সকল অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে।
কিন্তু অদম্য বড় হয়ে বাপের চেয়ে আরও একধাপ খ্যাপাটে ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। লেখাপড়ার ধার ধারেনি। বাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় শহরময়। সুদে টাকা খাটায়। টাকা দিতে দেরি হলে দেনাদারের সঙ্গে গুন্ডামি করে বাপে-পুতে মিলে। মাত্র পাঁচহাজারের জন্য ঘরের টেলিভিশন-ফ্রিজ সব বের করে নিয়ে নিজ বাড়িতে তোলে। সবাই ভয়ে-ত্রাসে কাঁপে। দুতিনবার জেলহাজতও খেটেছে। পুলিশের মার খেয়ে খেয়ে শরীর নীল হয়ে গেছে। তবু হোসনে আরার শ্বাশুড়ির সোহাগ মরে না। বউর কাছে বসে মন্তব্য ঝাড়ে,’ পুষ্যালোক মিউ মিউ করলে বিলাই বিলাই লাগে। গায়ের জোর না থাকলে কি কেউ মানে, কও?’
এখন মাথার উপর শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ নেই। শাশুড়ি বাজ খেয়ে মরেছে তেঁতুল গাছতলায়। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শরীর। শ্বশুর পানি-পানি করে খাট থেকে পড়ে সেখানেই দমটা গেছে। স্বামী হাসানের দুবার স্ট্রোক হয়ে মরণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। চেয়ারে বসে এককাত হয়ে শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করতে থাকে। হোসনে আরা ছাড়া ওর কথা আর কেউ বুঝতে পারে না। কথা বলার সময় অবিরাম থুতু ঝরে মুখ থেকে। তবু এখনও সামান্য এদিক-সেদিক হলে ওর গায়ে হাত তুলতে চায় অথর্ব স্বামী। চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে সে।
হোসনে আরা এককালে এই মূর্খ যণ্ডা লোকটারই প্রেমে মজেছিল। সুখের পাখি ওড়াতে চেয়েছিল আকাশে। এত মারধর খেয়েও ছেলেটার নাম রেখেছিল অদম্য। এইচএসসি পাস হোসনে আরা ভেবেছিল, ছেলেটা অদ্ভুত কিছু একটা হয়ে অন্ধকার মৃত্যুপুরীতে মশাল জ্বালাবে। কিন্তু সে-ও কবেই বাপের হাতে খুন হয়ে গেছে। এখন হোসনে আরা চোখের সামনে অন্য কেউ নয়, নির্দয়-নিষ্ঠুর স্বামীটারই ছায়া দেখতে পায় ছেলের মাঝে।
চোখে ছানি পরার পরও হোসনে আরা অদম্যর কথা ভেবে ঘোলা চোখ থেকে জল ঝরিয়েছে। কোন কাজে দেয়নি মায়ের সেই অশ্রু। বরং কোন বিরূপ কথা বললেই মারমুখী ছেলে তেড়ে আসে ওর দিকে, বুড়নি, বেশি বকবক করবি তো দাও দিয়া দুই টুকরা কইরা ফ্যালামু।’ একদিন তো এমন চড় মেরেছিল ওর গালে যে তিনদিন তব্দা খেয়ে থাকতে হল ওর। এসবে অভ্যস্ত সে। নতুন করে কোন মানে তৈরি করে না।
এখন ছেলের জন্যও মন আর কাঁদে না। শুধু সুযোগ পেলে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের উদ্দেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,’ দুনিয়াদারি অনেক দেখছি। এইবার আমারে লও।’
যেদিন অদম্যকে পুলিশের দল টানতে টানতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে ওঠাল সেদিনও শুষ্ক ঘোলা চোখে অস্পষ্ট আকাশকে
বলেছিল,’ আমারে লও। রহম কর খোদা।
সবাই বলল, ‘পোলারে বাঁচাইতে অইলে উকিল ধর।’
কিছু বলল না হোসনে আরা। হাজতে গিয়ে অদম্যকে প্রশ্ন করল,’ মাইয়াডিরে পিটাইলি কেরে?’
‘মাইয়াডা খারাপ পোশাক পরছিল। তুমারে কইতে পারুম না।’ ভদ্র ঠাণ্ডা গলায় জানাল।
‘তবু ক একবার। হুনি?’
‘নডি বেডিয়াইতের লাহান ডেরেস। লঞ্চঘাডে গিয়া টিকটক মারাইতেছে। একটা পুরা বাঁশ ভাংছি মাগির শরীরে। আরও দুইডা বান্ধবি আছিল। হিডিরেও হুতাই দিছি পিটাইতে পিটইতে। লাজ থাকলে আর জিন্দিগিতেও নডির পোশাক পইরা বাইর অইত না। ‘আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর কন্ঠ। যেন জীবনের সবচাইতে মহৎ কাজটা করে ফেলেছে সে।
হোসনে আরা কুঁজো শরীর নিয়ে একদৃষ্টে ছেলেকে দেখতে থাকে। হাসান জোয়ার্দারকেই সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। কোন কথা না বলে সে বাড়ি ফিরে আসে। ওর বাবার বাড়ির সামনে দিয়েই আসতে-যেতে হয় ওকে। রিক্সার হুড তুলে দিয়ে দম খিঁচে জায়গাটা পার হয় সে। মনে হয় বিশাল একটা পাহাড় পাড়ি দিচ্ছে সে। তবু কেন যেন মনে হয়, চল্লিশ বছর আগের আমগাছটা এখনও যেন ওকে চিনতে পারে। রাস্তার কিনার ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছটা ঠিক ওর মায়ের গলায় ডেকে ওঠে, আম্মা গো, একবার আয়। দেখে যা আমরারে।’ ভাবতেই হোসনে আরার শরীর শিউরে ওঠে। চোখ বুজে আসে তীব্র এক লজ্জায়।
বাড়ি ফিরে হাসান জোয়ার্দারকে অদম্য সম্পর্কে সব খুলে বলে সে। শুনে অথর্ব বুড়োর চোখমুখ জ্বল-জ্বল করে ওঠে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় গর্ব মিশিয়ে বলে,’ জাতিলা পুলা আমার। আম্মা দেখলে যে কী খুশি অইতো। উকিল দিয়া ছাড়াইয়া আন মাগি। বাপের পুলা।’
হোসনে আরার চোখ দুটো নিষ্ঠুর পাথর হয়ে যায়। অনুচ্চ কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘না।’
সঙ্গে সঙ্গে হাসান একদলা থুতু ছিটিয়ে দেয় ওকে তাক করে। যে-চেয়ারে নড়াচড়াহীন অবশ শরীরটি নিয়ে বসেছিল সেখান থেকে প্রচণ্ড রাগে ওর থরথরে হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে মারে হোসনে আরার দিকে।
হোসনে আরা নিরব দৃষ্টিতে আরও একবার দেখে নেয় স্বামীর এই চিরচেনা উন্মত্ত চেহারাটি। কোন কথা বলে না। শুধু মনে মনে বলে,’ আইজ তোরে ঘরে নিতাম না। হারা রাইত তুই বাইরে থাকবি। খাওন পাইতি না। ঘুমাইতে পারতি না। আমি খাইয়া- লইয়া নাক ডাইকা ঘুমামু।’ হোসনে আরা ঘরের ভেতর ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। প্রচুর হেসে নেয় মনে মনে। জানালার শিক ধরে বলে ওঠে,’
আইজ থেইক্যা তুই আমার বউ। আমি জামাই।’ বলে প্রাণের সুখে পুনরায় হেসে ওঠে। একসময় হাসিটা কান্নায় পরিণত হয়। চোখের সামনে আব্বার অপমানিত করুণ চেহারা ভাসে। মৃত্যুর সময়ও কি আব্বার চোখের সামনে একমাত্র কন্যার নিষ্পাপ চেহারাটা ভেসে উঠেছিল? আম্মার বেলায়ও তাই হয়েছিল?
আজকাল এসব যে খুব জানতে চায় মন!