০২:৫৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

ইরান যুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থার সুযোগ

একটি নতুন আঞ্চলিক বাস্তবতা

পাঁচ দশক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন ঘোষণা করেছিলেন, যারা ইসরায়েলের ধ্বংস চাইবে, তাদের কখনো পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া হবে না। ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল এই নীতিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী অভিযানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক আঘাত হানা হয়েছে।

ইরাক (১৯৮১) এবং সিরিয়া (২০০৭)-তে যেমন হামলা করা হয়েছিল, এ অভিযান তার চেয়েও জটিল। ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ছড়ানো, সুগভীরভাবে সুরক্ষিত এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল সফলভাবে বহু স্থাপনা ধ্বংস করেছে—যা এক ঐতিহাসিক সামরিক কৃতিত্ব।

ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্বল অবস্থায় ছিল। হামাস, হিজবুল্লাহ ও আসাদ সরকারের মতো মিত্ররা বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হেরে গেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল এই জটিল পারমাণবিক কর্মসূচিতে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এটি বেগিন নীতির প্রথম যৌথ প্রয়োগ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই অভিযানের পর মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতির একটি নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। তেহরান দুর্বল অবস্থায় থাকায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী পারমাণবিক সমঝোতা, এমনকি আরও বিস্তৃত রাজনৈতিক চুক্তি করে গোটা অঞ্চলকে নতুন আকার দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

ইসরায়েলের হামলার পটভূমি

দুটি প্রধান কারণ ইসরায়েলকে হামলার পথে ঠেলেছে। প্রথমত, ইরানের ক্রমবর্ধমান হুমকি। ইসরায়েলি গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক বোমার দিকে এগোচ্ছিল এবং এর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ৩,০০০ থেকে ৮,০০০ করার পরিকল্পনা করেছিল। হামাসকে অর্থায়ন করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলাও তারা চালিয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে ছোঁড়া হয়।

দ্বিতীয়ত, ইরানের অস্থায়ী দুর্বলতা। মাসব্যাপী ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে যায়। আসাদ সরকারের পতন ঘটে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ২০২৪ সালের ইসরায়েলি হামলায় স্পষ্টভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়। জুনের হামলা এমন এক সময়ে করা হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারমাণবিক আলোচনার জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ করেছিলেন।

অপারেশন রাইজিং লায়নের প্রধান লক্ষ্য ছিল—ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে দীর্ঘমেয়াদে পেছনে ঠেলে দেওয়া, একটি ভালো পারমাণবিক চুক্তির পরিস্থিতি তৈরি করা এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমানো। এর পাশাপাশি ইসরায়েল চেয়েছিল—ইরানি সরকারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি পদক্ষেপে প্ররোচিত করা।

অভিযানের বিস্তারিত

ইসরায়েল প্রথমেই একটি ‘ডিক্যাপিটেশন স্ট্রাইক’ চালিয়ে প্রায় ২০ জন শীর্ষ সামরিক নেতা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী হত্যা করে, যাদের মধ্যে আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি, ক্ষেপণাস্ত্র কৌশলের রূপকার আমির আলী হাজিজাদেহ এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি ছিলেন।

এরপর ১২০০-এর বেশি বিমান অভিযান চালিয়ে ইরানের প্রায় ১৩০টি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাটারির ৮০ শতাংশ ধ্বংস করা হয়। তেহরানের উপর আকাশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়—যা সামরিক ইতিহাসে নজিরবিহীন সাফল্য।

ইরানের নাতানজ, ফোরডো, ইস্পাহান এবং আরাক-এর গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা হয়। আইআরজিসি এবং কুদস ফোর্সের সদরদপ্তরও আঘাত হানে। ৪০০০-এর বেশি নির্ভুল গাইডেড বোমা ফেলা হয়। প্রায় ১৪০০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত টার্গেট করা হয়।

ইসরায়েল প্রায় ১০০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ২০০-এর বেশি লঞ্চার ধ্বংস করে। ফলে যুদ্ধে ইরানের দৈনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ১০০ থেকে ১২-তে নেমে আসে। ইসরায়েলের বহুতল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (অ্যারো, ডেভিড’স স্লিং, আয়রন ডোম) এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ৬০০-এর কাছাকাছি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৬ শতাংশ এবং ১০০০ ড্রোনের ৯৯.৫ শতাংশ সফলভাবে ধ্বংস করা হয়।

তবে, প্রায় ৪০ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানে—বিয়ারশেবা, হাইফা, এবং তেল আভিভের মতো শহরে। এতে ২৯ জন নিহত, ৩০০০ এর বেশি আহত এবং ১৫,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলি পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। ইসরায়েল ইরানের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

অভিযানের ফলাফল ও বিতর্ক

অভিযানের সাফল্য পরিমাপ করা সহজ নয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র ও তথ্য মিলিয়ে এর মূল্যায়ন করতে হয়। কিছু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। আবার ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।

মূল প্রশ্ন হলো—ইরান এখন কী অবস্থায় আছে, তাদের হাতে কী আছে, তারা কী করবে এবং পরবর্তী ধাপগুলো কীভাবে আটকানো যাবে—কূটনীতি, চাপ বা প্রতিরোধের মাধ্যমে।

ইরানের কাছে এখন নানা পথ খোলা। তারা আবার আলোচনায় ফিরতে পারে, বা সরাসরি পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। তারা আলোচনার ভান করে গোপনে কর্মসূচি এগিয়েও নিতে পারে। ইতিমধ্যে তারা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার (IAEA) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে এবং এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে।

কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা

যতই সাফল্য আসুক, ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে কূটনৈতিক সমাধান। নতুন চুক্তি করতে হবে, যাতে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে বাধ্য করা যায় এবং কঠোর পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে আলোচনায় এগোতে হবে। ইরানকে পরমাণু বা সামরিক উত্তেজনা থেকে দূরে রাখতে এবং একটি টেকসই চুক্তি করতে এই সমন্বয় প্রয়োজন।

এছাড়া ইরান ও তার সহযোগীদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গড়া সম্ভব। হামলার ফলে গাজায় বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি, হামাসের নেতৃত্বের দেশান্তর, অস্ত্র জমা ও গাজার পুনর্গঠন করা যেতে পারে।

সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গেও নিরাপত্তা চুক্তি হতে পারে—যেখানে তারা হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি কমাতে সম্মত হবে। এসব চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি থেকে স্থায়ী শান্তি চুক্তি পর্যন্ত ধাপে ধাপে অগ্রগতি সম্ভব।

যে কোনো বড় সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তির পর্যবেক্ষণ মিশনের মতো নমনীয় কাঠামো কার্যকর হতে পারে।

শেষ কথা

যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কেবল পারমাণবিক ইস্যু নিয়েও সমঝোতায় আসে, তবুও সামরিক অভিযানের অর্থ হবে—“শক্তির মাধ্যমে শান্তি” নীতি বাস্তবে প্রমাণ করা। জুনের হামলা দেখিয়েছে, সমন্বিত সামরিক অভিযান পারমাণবিক বিস্তার থামাতে পারে।

অভিযান এটাও দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একসঙ্গে থেকে সঠিক পরিকল্পনা করলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর। এতে রাশিয়া ও চীনের প্রভাবও সীমিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ পরাজিত পক্ষ সাধারণত সবচেয়ে বেশি শিখে। ইরানও হামলার থেকে শিক্ষা নেবে, নতুন কৌশল তৈরি করবে।

অপারেশন রাইজিং লায়ন তাৎক্ষণিক হুমকি কমিয়েছে, অসাধারণ সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, এবং এক নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার জানালা খুলেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব—যা ইরানের পারমাণবিক স্বপ্ন বন্ধ করবে এবং দুই মিত্রের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে।

( ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখকের লেখাটির মূল অংশের অনুবাদ)

ইরান যুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থার সুযোগ

১১:০০:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

একটি নতুন আঞ্চলিক বাস্তবতা

পাঁচ দশক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন ঘোষণা করেছিলেন, যারা ইসরায়েলের ধ্বংস চাইবে, তাদের কখনো পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া হবে না। ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল এই নীতিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে প্রায় দুই সপ্তাহব্যাপী অভিযানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক আঘাত হানা হয়েছে।

ইরাক (১৯৮১) এবং সিরিয়া (২০০৭)-তে যেমন হামলা করা হয়েছিল, এ অভিযান তার চেয়েও জটিল। ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ছড়ানো, সুগভীরভাবে সুরক্ষিত এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল সফলভাবে বহু স্থাপনা ধ্বংস করেছে—যা এক ঐতিহাসিক সামরিক কৃতিত্ব।

ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্বল অবস্থায় ছিল। হামাস, হিজবুল্লাহ ও আসাদ সরকারের মতো মিত্ররা বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হেরে গেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল এই জটিল পারমাণবিক কর্মসূচিতে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এটি বেগিন নীতির প্রথম যৌথ প্রয়োগ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই অভিযানের পর মধ্যপ্রাচ্যে কূটনীতির একটি নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। তেহরান দুর্বল অবস্থায় থাকায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী পারমাণবিক সমঝোতা, এমনকি আরও বিস্তৃত রাজনৈতিক চুক্তি করে গোটা অঞ্চলকে নতুন আকার দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

ইসরায়েলের হামলার পটভূমি

দুটি প্রধান কারণ ইসরায়েলকে হামলার পথে ঠেলেছে। প্রথমত, ইরানের ক্রমবর্ধমান হুমকি। ইসরায়েলি গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক বোমার দিকে এগোচ্ছিল এবং এর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ৩,০০০ থেকে ৮,০০০ করার পরিকল্পনা করেছিল। হামাসকে অর্থায়ন করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলাও তারা চালিয়েছিল। এছাড়া ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবর মাসে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে ছোঁড়া হয়।

দ্বিতীয়ত, ইরানের অস্থায়ী দুর্বলতা। মাসব্যাপী ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযানে হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে যায়। আসাদ সরকারের পতন ঘটে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ২০২৪ সালের ইসরায়েলি হামলায় স্পষ্টভাবে অকার্যকর প্রমাণিত হয়। জুনের হামলা এমন এক সময়ে করা হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারমাণবিক আলোচনার জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ করেছিলেন।

অপারেশন রাইজিং লায়নের প্রধান লক্ষ্য ছিল—ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিকে দীর্ঘমেয়াদে পেছনে ঠেলে দেওয়া, একটি ভালো পারমাণবিক চুক্তির পরিস্থিতি তৈরি করা এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব কমানো। এর পাশাপাশি ইসরায়েল চেয়েছিল—ইরানি সরকারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি পদক্ষেপে প্ররোচিত করা।

অভিযানের বিস্তারিত

ইসরায়েল প্রথমেই একটি ‘ডিক্যাপিটেশন স্ট্রাইক’ চালিয়ে প্রায় ২০ জন শীর্ষ সামরিক নেতা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী হত্যা করে, যাদের মধ্যে আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি, ক্ষেপণাস্ত্র কৌশলের রূপকার আমির আলী হাজিজাদেহ এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি ছিলেন।

এরপর ১২০০-এর বেশি বিমান অভিযান চালিয়ে ইরানের প্রায় ১৩০টি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাটারির ৮০ শতাংশ ধ্বংস করা হয়। তেহরানের উপর আকাশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়—যা সামরিক ইতিহাসে নজিরবিহীন সাফল্য।

ইরানের নাতানজ, ফোরডো, ইস্পাহান এবং আরাক-এর গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা হয়। আইআরজিসি এবং কুদস ফোর্সের সদরদপ্তরও আঘাত হানে। ৪০০০-এর বেশি নির্ভুল গাইডেড বোমা ফেলা হয়। প্রায় ১৪০০ মাইল দূরত্ব পর্যন্ত টার্গেট করা হয়।

ইসরায়েল প্রায় ১০০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ২০০-এর বেশি লঞ্চার ধ্বংস করে। ফলে যুদ্ধে ইরানের দৈনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ১০০ থেকে ১২-তে নেমে আসে। ইসরায়েলের বহুতল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (অ্যারো, ডেভিড’স স্লিং, আয়রন ডোম) এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ৬০০-এর কাছাকাছি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৬ শতাংশ এবং ১০০০ ড্রোনের ৯৯.৫ শতাংশ সফলভাবে ধ্বংস করা হয়।

তবে, প্রায় ৪০ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানে—বিয়ারশেবা, হাইফা, এবং তেল আভিভের মতো শহরে। এতে ২৯ জন নিহত, ৩০০০ এর বেশি আহত এবং ১৫,০০০ মানুষ গৃহহীন হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলি পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক কম হয়েছে। ইসরায়েল ইরানের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

অভিযানের ফলাফল ও বিতর্ক

অভিযানের সাফল্য পরিমাপ করা সহজ নয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র ও তথ্য মিলিয়ে এর মূল্যায়ন করতে হয়। কিছু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। আবার ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।

মূল প্রশ্ন হলো—ইরান এখন কী অবস্থায় আছে, তাদের হাতে কী আছে, তারা কী করবে এবং পরবর্তী ধাপগুলো কীভাবে আটকানো যাবে—কূটনীতি, চাপ বা প্রতিরোধের মাধ্যমে।

ইরানের কাছে এখন নানা পথ খোলা। তারা আবার আলোচনায় ফিরতে পারে, বা সরাসরি পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। তারা আলোচনার ভান করে গোপনে কর্মসূচি এগিয়েও নিতে পারে। ইতিমধ্যে তারা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার (IAEA) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে এবং এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে।

কূটনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা

যতই সাফল্য আসুক, ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে কূটনৈতিক সমাধান। নতুন চুক্তি করতে হবে, যাতে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে বাধ্য করা যায় এবং কঠোর পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে আলোচনায় এগোতে হবে। ইরানকে পরমাণু বা সামরিক উত্তেজনা থেকে দূরে রাখতে এবং একটি টেকসই চুক্তি করতে এই সমন্বয় প্রয়োজন।

এছাড়া ইরান ও তার সহযোগীদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গড়া সম্ভব। হামলার ফলে গাজায় বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি, হামাসের নেতৃত্বের দেশান্তর, অস্ত্র জমা ও গাজার পুনর্গঠন করা যেতে পারে।

সিরিয়া ও লেবাননের সঙ্গেও নিরাপত্তা চুক্তি হতে পারে—যেখানে তারা হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি কমাতে সম্মত হবে। এসব চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি থেকে স্থায়ী শান্তি চুক্তি পর্যন্ত ধাপে ধাপে অগ্রগতি সম্ভব।

যে কোনো বড় সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। মিশর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তির পর্যবেক্ষণ মিশনের মতো নমনীয় কাঠামো কার্যকর হতে পারে।

শেষ কথা

যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কেবল পারমাণবিক ইস্যু নিয়েও সমঝোতায় আসে, তবুও সামরিক অভিযানের অর্থ হবে—“শক্তির মাধ্যমে শান্তি” নীতি বাস্তবে প্রমাণ করা। জুনের হামলা দেখিয়েছে, সমন্বিত সামরিক অভিযান পারমাণবিক বিস্তার থামাতে পারে।

অভিযান এটাও দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একসঙ্গে থেকে সঠিক পরিকল্পনা করলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর। এতে রাশিয়া ও চীনের প্রভাবও সীমিত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তবে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ পরাজিত পক্ষ সাধারণত সবচেয়ে বেশি শিখে। ইরানও হামলার থেকে শিক্ষা নেবে, নতুন কৌশল তৈরি করবে।

অপারেশন রাইজিং লায়ন তাৎক্ষণিক হুমকি কমিয়েছে, অসাধারণ সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, এবং এক নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার জানালা খুলেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব—যা ইরানের পারমাণবিক স্বপ্ন বন্ধ করবে এবং দুই মিত্রের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে।

( ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখকের লেখাটির মূল অংশের অনুবাদ)