লন্ডন—যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স বৃহস্পতিবার একটি নতুন চুক্তি করেছে, যার লক্ষ্য ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ছোট নৌকায় রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসীর আগমন ঠেকানো। দুই দেশেই অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিকদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চুক্তির মূল শর্তাবলি
চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য যেসব অভিবাসীকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠাবে, ফ্রান্স সেখান থেকে সমসংখ্যক সেই অভিবাসী নেবে যাদের যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নিবিড় যোগ আছে—যেমন পরিবার বা কাজের সংযোগ।
ফ্রান্সের পুলিশকে উপকূল থেকে যাত্রা ঠেকাতে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘‘ছোট নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা কেবল ব্যর্থতা, আটক এবং দেশে ফেরতের মাধ্যমে শেষ হবে।’’ তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শেষ দিনে এই বার্তা দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ
ফ্রান্সের সঙ্গে এই অভিবাসী বিনিময় চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোতে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
স্পেন, ইতালি, গ্রিস, মাল্টা ও সাইপ্রাস ইতিমধ্যেই ইইউ-কে লিখিতভাবে জানিয়েছে, তারা ভয় পায়—যেসব অভিবাসী যুক্তরাজ্য থেকে ফ্রান্সে ফেরত যাবে, তারা আবার তাদের দেশগুলোর দিকে চলে আসবে।
মাখোঁ বলেন, ‘‘অবৈধ ও গোপন অভিবাসন নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা সবাই একমত। এটি পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’’
চুক্তির পাইলট প্রকল্প
স্টারমার জানান, এটি প্রথমে একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শুরু হবে—কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই। তবে বিস্তারিত কাঠামো তিনি জানাননি।
মাখোঁ বলেন, এই পাইলট প্রকল্প যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগ থাকা অভিবাসীদের বৈধভাবে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করবে এবং যারা ছোট নৌকায় করে আসবে, তাদের ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হবে সমপরিমাণ ভিত্তিতে।
রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসীর আগমন
যুক্তরাজ্য, যেমন যুক্তরাষ্ট্র তার দক্ষিণ সীমান্তে অভিবাসী ঢল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তেমনি ক্রমবর্ধমান সংখ্যক অভিবাসী ছোট নৌকায় করে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে প্রবেশ করছে।
ইংলিশ চ্যানেলের সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ২১ মাইল।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ২১,১৯০ জন অভিবাসী চ্যানেল পেরিয়েছে, যা অতীতের যে কোনো বছরের তুলনায় রেকর্ড গতিতে বেড়েছে। ২০২২ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৩,৩১৮।
গ্রীষ্ম ও শুরুর শরতে সমুদ্র তুলনামূলক শান্ত থাকায় তখনই পারাপার সবচেয়ে বেশি হয়।
যুক্তরাজ্যে অভিবাসন নিয়ে রাজনৈতিক চাপ
সম্প্রতি বৈধ ও অবৈধ দুই ধরনের অভিবাসনই রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিকে উসকে দিচ্ছে।
অভিবাসনবিরোধী রিফর্ম ইউকে পার্টি, যার নেতৃত্বে আছেন ব্রেক্সিটপন্থী নাইজেল ফারাজ, প্রথমবারের মতো জনমত জরিপে শীর্ষে উঠে এসেছে।
ভোটারদের মধ্যে অভিবাসনই শীর্ষ উদ্বেগের বিষয়।
স্টারমারের সরকার ক্ষমতায় প্রথম বছরে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। তারা বৈধ অভিবাসন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিলেও, অবৈধ পারাপার বন্ধে প্রতিশ্রুত ‘গ্যাং ধ্বংস’ অভিযান খুব একটা সফল হয়নি।
ফ্রান্সেও রাজনৈতিক চাপ
ফ্রান্সে সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসনবিরোধী ন্যাশনাল র্যালি পার্টির নেতা জর্ডান বারডেলা দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক, তার সমর্থন ৩৬ শতাংশ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইগ্রেশন অবজারভেটরির উপদেষ্টা পিটার ওয়ালশ বলেন, আগে যেসব যৌথ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়—‘ওয়ান ইন, ওয়ান আউট’ পদ্ধতিও কতটা কার্যকর হবে, তা স্পষ্ট নয়।
ফ্রান্সকে যুক্তরাজ্যে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সংযোগ থাকা অভিবাসী খুঁজে বের করতে হবে। বাস্তবে এমন অভিবাসীর সংখ্যা কতটা পাওয়া যাবে, তা অনিশ্চিত।
ওয়ালশ বলেন, প্রকল্পটি ভয় দেখিয়ে ঠেকাতে হলে, হাজার হাজার অভিবাসীকে ফেরত পাঠাতে হবে।
নৌকায় ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার
এই নৌকাগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘিঞ্জি করা থাকে। যুক্তরাজ্যের জলসীমায় প্রবেশের পর এগুলোকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুসারে, কোনো বিপদে থাকা নৌযানকে সহায়তা করা বাধ্যতামূলক।
ফরাসি কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ২০২৫ সালে অন্তত ১৭ জন অভিবাসী চ্যানেল পেরোনোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রায়ই আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরানসহ উন্নয়নশীল দেশের তরুণ অভিবাসীদের ঘিঞ্জি নৌকার ছবি ছাপা হয়।
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রতিদিন ‘স্মল বোটস ট্র্যাকার’ নামে আপডেট দেয়।
অর্থ সহায়তা এবং নিরাপত্তা উদ্যোগ
২০২২ সালে যুক্তরাজ্য ফ্রান্সকে প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয় তিন বছরের জন্য, যাতে ফরাসি উপকূলে অভিবাসী পারাপার ঠেকানো যায়। উত্তর ফ্রান্সের কালে শহর ও আশেপাশে হাজার হাজার অভিবাসী অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকে, ঝুঁকিপূর্ণ এই যাত্রার জন্য অপেক্ষায়।
একটি বড় সমস্যা হলো—ফরাসি পুলিশ সাধারণত পানিতে থাকা নৌকাগুলোকে থামায় না।ফরাসি কর্মকর্তারা বলেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর জন্য ফৌজদারি দায় হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এখন ফরাসি সরকার একটি নতুন নীতি তৈরি করছে, যাতে উপকূল থেকে ৩০০ গজ পর্যন্ত পুলিশ হস্তক্ষেপ করে নৌকা আটকে দিতে পারে।