এশিয়ায় ক্যানসার এখন মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে যত ক্যানসার রোগী মারা যান, তার অর্ধেকেরও বেশি এই অঞ্চলের। নগরায়ন, বয়স বাড়া, ধূমপান, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে স্তন, ফুসফুস, কোলন, জরায়ুমুখ, লিভার ও পাকস্থলির ক্যানসার দ্রুত বাড়ছে।
চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন—
-
৪০ বছরের বেশি নারীদের বছরে একবার স্তন পরীক্ষা ও ম্যামোগ্রাম করানো উচিত।
-
৫০ বছরের বেশি পুরুষদের জন্য প্রস্টেট পরীক্ষা উপযোগী।
-
উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রে ৪৫ বছরের পর থেকে কোলন ক্যানসারের স্ক্রিনিং দরকার।
-
জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে ২১ বছর থেকে প্যাপ স্মিয়ার এবং HPV ভ্যাকসিন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
-
ধূমপায়ী বা দূষণপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী ব্যক্তিদের নিয়মিত ফুসফুসের স্ক্যান করা দরকার।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এশিয়ার কয়েকটি দেশের কিছু হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত চিকিৎসা দিচ্ছে। নিচে পাঁচটি কেন্দ্র এবং তাদের চিকিৎসার খরচ তুলে ধরা হলো।
১. থাইল্যান্ড – চুলাভর্ণ হাসপাতাল ও ইমক্রানিব ১০০
স্থানীয় ওষুধ উৎপাদনে বিপ্লব:
২০২৫ সালের জুলাইয়ে, থাইল্যান্ডে তৈরি ইমক্রানিব ১০০ নামে একটি জেনেরিক ওষুধ বাজারে আনা হয়, যা ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (CML), জিআইএসটি (GIST) এবং Ph+ একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি চুলাভর্ণ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে তৈরি হয় এবং থাই FDA অনুমোদিত।
সচেতনতা ও প্রতিরোধ:
থাইল্যান্ডে লিভার, স্তন ও ফুসফুস ক্যানসার দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, গ্রামীণ অঞ্চলে রোগ ধরা পড়ে দেরিতে—এজন্য সচেতনতা, বছরে একবার স্ক্রিনিং ও রুটিন চেকআপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১ মার্কিন ডলার = আনুমানিক ১২২ টাকা (জুলাই ২০২৫ অনুযায়ী)
খরচের ধারণা:
-
ইমক্রানিব ১০০: প্রতি ট্যাবলেটের দাম আনুমানিক ৩,৪১৬ টাকা (মার্কিন $28)।
-
কেমোথেরাপি (এক কোর্স): আনুমানিক ২,৪৪,০০০–৭,০৭,৬০০ টাকা (মার্কিন $2,000–$5,800)।
-
টার্গেটেড ইনজেকশন (যেমন ট্রাস্টুজুম্যাব): প্রতি ডোজে ৩,২৯,৪০০ টাকা বা তার বেশি (মার্কিন $2,700+)।
থাইল্যান্ডের স্থানীয় ওষুধ উৎপাদন ক্যানসার চিকিৎসার খরচ কমিয়ে আনার বড় পদক্ষেপ, বিশেষ করে লিউকেমিয়া ও সলিড টিউমার চিকিৎসায়।
২. ভারত – টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার (মুম্বাই ও জাতীয় নেটওয়ার্ক)
ভারতের জাতীয় ক্যানসার সেন্টার:
টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার (TMC) হলো ভারতের সবচেয়ে উন্নত ক্যানসার হাসপাতাল নেটওয়ার্ক। প্রতি বছর প্রায় ১,২০,০০০ রোগী এখানে চিকিৎসা পান। এখানে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, প্রোটন থেরাপি ও CAR‑T ট্রায়াল হয়ে থাকে।
খরচ ও সহজলভ্যতা:
প্রায় ৬০% রোগী সরকারিভাবে বিনামূল্যে অথবা কম খরচে চিকিৎসা পান।
আনুমানিক খরচ (১ ডলার = ১২২ টাকা অনুযায়ী):
-
কেমোথেরাপি (প্রতি চক্র): আনুমানিক ২৯,২৮০ টাকা ($240)।
-
সার্জারি: ২,১৯,৬০০–৬,৫৮,৮০০ টাকা ($1,800–$5,400)।
-
রেডিয়েশন থেরাপি (প্রতি সেশন): ৩,৬৬০–৬,৭১০ টাকা ($30–$55)।
-
প্রোটন থেরাপি (পুরো কোর্স): ১৪,৬৪,০০০–৪৩,৯২,০০০ টাকা ($12,000–$36,000)।
ভারতের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন, বিশ্বমানের ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা।
৩. ভারত (আঞ্চলিক কেন্দ্র) – আরসিসি ত্রিভান্দ্রম ও কিডওয়াই, বেঙ্গালুরু
আঞ্চলিক চিকিৎসার অগ্রগতি:
-
আরসিসি, কেরালা: প্রতিবছর প্রায় ১৬,০০০ রোগীর চিকিৎসা হয়। বেশিরভাগই কম খরচে কেমোথেরাপি ও স্ক্যানিং পান।
-
কিডওয়াই ইনস্টিটিউট, বেঙ্গালুরু: গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। কম দামে কেমো ও রেডিয়েশন সেবা দেয়।
গ্রামীণ ও শহরতলির মানুষের জন্য জরায়ুমুখ, স্তন ও মুখগহ্বর ক্যানসারের সাশ্রয়ী এবং প্রাথমিক চিকিৎসার অন্যতম ভিত্তি।
৪. চীন – সান ইয়াত-সেন ইউনিভার্সিটি ও শাংহাই ক্যানসার সেন্টার
উদ্ভাবন ও গবেষণা শক্তি:
চীনের দুটি শীর্ষ কেন্দ্র, SYSUCC ও ফুদান ইউনিভার্সিটি ক্যানসার সেন্টার, ইমিউনোথেরাপি, জিন-ভিত্তিক ডায়াগনস্টিক, এবং AI নির্ভর চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব দিচ্ছে।
খরচের ধারণা:
-
ব্যক্তিগত চিকিৎসা: আনুমানিক ১২,২০,০০০–৩৬,৬০,০০০ টাকা ($10,000–$30,000)।
-
সরকারি স্বাস্থ্য বীমার আওতায় লিভার ও ফুসফুস ক্যানসারের জন্য ওষুধ ও স্ক্যান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকলেও চীনে চিকিৎসার ব্যয় ও প্রবেশাধিকার অঞ্চলভেদে ভিন্ন রকম।
৫. ভারত – KGMU লক্ষ্ণৌ (HIPEC ও উন্নত রেডিয়েশন)
বিশেষায়িত চিকিৎসা:
-
HIPEC: পেটের ক্যানসারের জন্য ব্যবহৃত হাইপারথারমিক ইনট্রাপেরিটোনিয়াল কেমোথেরাপি KGMU-তে পাওয়া যায় মাত্র ৪৩,৯২০ টাকা ($360)।
-
কামা হাসপাতাল, মুম্বাই: সরকারিভাবে আবার শুরু হয়েছে ফ্রি রেডিয়েশন থেরাপি।
শিশুদের জন্য উদ্ভাবনী চিকিৎসা:
২০২৫ সালে, টাটা ACTREC সর্বোচ্চ ডোজের শিশু রেডিয়েশন প্রয়োগ করেছে, যা ব্যয় কমিয়ে চিকিৎসার মান বাড়িয়েছে।
ভারতের আঞ্চলিক হাসপাতালগুলো কম খরচে উন্নত চিকিৎসা দিচ্ছে, বিশেষ করে জটিল ও শিশু ক্যানসার চিকিৎসায়।
ক্যানসার এখনও ভয়াবহ স্বাস্থ্যচ্যালেঞ্জ। কিন্তু থাইল্যান্ডের ওষুধ উদ্ভাবন, ভারতের প্রযুক্তি ও জনমুখী হাসপাতাল, আর চীনের গবেষণাভিত্তিক অগ্রগতি প্রমাণ করে, এশিয়া এই লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই।
যারা চিকিৎসার সন্ধানে আছেন, তাদের উচিত—
-
আগেভাগেই স্ক্রিনিং করানো,
-
সরকারি সহায়তা ও বীমা খুঁজে দেখা,
-
এবং নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ নেওয়া।
এই সতর্কতা ও সচেতনতাই হতে পারে জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।