মাছ বিক্রেতা রশিদের সকাল
সকাল সাতটা বাজে। পুরান ঢাকার এক প্রান্তে মাছের বাজারে হট্টগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আবদুর রশিদ। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। মাছের দোকানটা তাঁর বাবার আমলে শুরু হয়েছিল, এখন নিজেই চালান। হাতে ছুরি, সামনে বরফে ঢাকা কিছু রুই, কাতলা আর পাঙ্গাস মাছ। একসময় দিনে ২০–২৫ কেজি মাছ বিক্রি করতেন তিনি। এখন সেখানে আটকে গেছেন ৭–৮ কেজিতে। মাছের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ দূরে থাক, ছোট রেস্তোরাঁগুলো পর্যন্ত আগের মতো নিচ্ছে না।
ক্রেতা কমছে, কষ্ট বাড়ছে
রশিদ বলছিলেন, “আগে ভোরবেলায় দোকান খুলতেই ভিড় লেগে যেত। এখন ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একজন ক্রেতার আশায়। যে পরিবার আগে ২ কেজি রুই কিনতো, এখন আধা কেজি কিনেই ফিরছে। বলছে ‘ভাই, ছেলেমেয়েদের স্কুলের খরচ, বাসাভাড়া, চাল-ডালের দাম—সব মিলে মাছ কেনা এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে।’”
বিশেষ করে রুই, কাতলা, বোয়াল—এসব দেশি মাছের দাম গত এক মাসেই কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০–১৫০ টাকা। খুচরা বাজারে রুই এখন ৫৫০–৬৫০ টাকা, কাতলা ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। রশিদের ভাষায়, “এই দামে মানুষ চাইলেও কিনতে পারে না। আমিও কম দামে বিক্রি করতে পারি না, কারণ পাইকারি বাজারেই তো দাম বেশি।”
সংসারে টানাপোড়েন
মাছ বিক্রেতা রশিদের সংসারে আছেন স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে, ছেলেটা মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। রশিদের চোখে হতাশা: “মেয়ের স্কুলের ফি জমেছে দুই মাসের। দোকানের আয় দিয়ে আগে সংসার চালাতাম, বাচ্চাদের পড়াশোনাও চলতো, কিছু সঞ্চয়ও হতো। এখন মাস শেষে হিসাব মিলাতে পারি না।”
স্ত্রী আগে বাড়িতে হাতের কাজ করতেন। সেসব বন্ধ হয়ে গেছে খরচের চাপে। রশিদ নিজেও মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে ঢাকায় মাছ এনে বিক্রির চেষ্টা করেন, যাতে দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু পরিবহন খরচ, বরফ, বাজার ফি—সব মিলিয়ে লাভ তো হয়ই না, উল্টো কিছু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়।
ভাঙছে মন, তবুও লড়াই
রশিদ বলেন, “অনেক দিন হয় ভাতের সঙ্গে মাছ খাওয়া হয়নি। আমি তো মাছ বিক্রি করি, কিন্তু আমার ঘরেই এখন ডিম বা ডালেই দিন চলে যায়। কী আশ্চর্য, না? মাছ বিক্রেতার ঘরেই মাছ নেই!”
বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে কিছু পাইকার—এই অভিযোগও তুললেন তিনি। “ওরা দল বেঁধে মাছ কিনে রাখে, পরে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমি চাইলে ওদের সঙ্গে পারি না। তাই আমার মতো খুচরা বিক্রেতারা সব দিশেহারা।”
সরকারের দিকে তাকিয়ে
সরকারি নজরদারির ঘাটতির কথাও বললেন রশিদ। তাঁর মতে, “দাম বেঁধে দিলেই হবে না, কার্যকর মনিটরিং লাগবে। বাজারে যদি ঠিকমতো নজর রাখা হতো, তাহলে এত অস্বাভাবিক দাম হতো না। সাধারণ মানুষও মাছ কিনতে পারতো, আমাদেরও ব্যবসা চলতো।”
আশার আলো কোথায়?
তবে রশিদ হাল ছাড়েননি। প্রতিদিনই দোকান খুলেন, আশায় থাকেন—আজ হয়তো বিক্রি ভালো হবে। সরকারি সাহায্যের কোনো খোঁজ পাননি তিনি। এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিটের পথেও হাঁটেননি। তাঁর কথা, “ঋণ নিয়ে কী করবো? বিক্রি না হলে ঋণও শোধ হবে না। আমি চাই বাজারটা একটু স্থিতিশীল হোক, মানুষ মাছ কিনুক, আবার সেই পুরনো দিনের মতো হোক দোকানের ব্যস্ততা।”
ক্লান্ত বাজারের মানুষ
এই প্রতিবেদন এক রশিদের গল্প হলেও, ঢাকার প্রতিটি বাজারে আছে এমন শত শত মাছ বিক্রেতা, যারা এখন জীবনযুদ্ধে হার মানছেন না, কিন্তু ক্লান্ত। মাছ আমাদের জাতীয় খাবারের অংশ, অথচ সেটাই আজ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই সংকট শুধু একটি পেশার নয়, বরং বৃহত্তর সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য এক জরুরি সংকেত—মানুষ আর মাছের এই দূরত্ব যেন চিরস্থায়ী না হয়।