০১:৩২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
শহরের স্পন্দনে কুপ্রা: সিটি গ্যারেজে বদলে যাচ্ছে নগর সংস্কৃতির মানচিত্র ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত, ঋণের চাপ আর সংস্কারের চ্যালেঞ্জ: শ্রীলঙ্কা এক সংকটে আটকে পড়েছে জিএমের বৈশ্বিক দৌড় ফর্মুলা ওয়ানকে হাতিয়ার করে নতুন বাজারে আমেরিকার অটো জায়ান্ট মাদুরো পতনের ছক কি যুদ্ধ ডেকে আনবে ক্যারিবিয়ানে ভারতের টিকা সাম্রাজ্য: উদ্ভাবনের শক্তিতে সিরাম ইনস্টিটিউট এর বিশ্বজয় চারটি এমভিপি চারটি শিরোপা অজেয় আয়শা উইলসনের রাজত্ব লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও: পরিবর্তনের ভেতর টিকে থাকার অভিনয়শিল্পী কেপপ ডেমন হান্টার্স: আবেগ থেকে বৈশ্বিক উন্মাদনা, এক অ্যানিমেশনের অসম্ভব জয়যাত্রা ভেনিজুয়েলা প্রশ্নে ট্রাম্পে আস্থা, মাদুরো হটাতে পারলেই সব ক্ষমা ডোরালের নির্বাসিতদের কণ্ঠ যুদ্ধবিরতি ছাড়াই শেষ আসিয়ান বৈঠক, আবার আলোচনায় বসছে থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া

মানুষ আর মাছের দূরত্ব: এক মাছ বিক্রেতার জীবনের লড়াই

মাছ বিক্রেতা রশিদের সকাল

সকাল সাতটা বাজে। পুরান ঢাকার এক প্রান্তে মাছের বাজারে হট্টগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আবদুর রশিদ। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। মাছের দোকানটা তাঁর বাবার আমলে শুরু হয়েছিলএখন নিজেই চালান। হাতে ছুরিসামনে বরফে ঢাকা কিছু রুইকাতলা আর পাঙ্গাস মাছ। একসময় দিনে ২০২৫ কেজি মাছ বিক্রি করতেন তিনি। এখন সেখানে আটকে গেছেন ৭৮ কেজিতে। মাছের দাম যে হারে বেড়েছেতাতে সাধারণ মানুষ দূরে থাকছোট রেস্তোরাঁগুলো পর্যন্ত আগের মতো নিচ্ছে না।

ক্রেতা কমছেকষ্ট বাড়ছে

রশিদ বলছিলেন, “আগে ভোরবেলায় দোকান খুলতেই ভিড় লেগে যেত। এখন ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একজন ক্রেতার আশায়। যে পরিবার আগে ২ কেজি রুই কিনতোএখন আধা কেজি কিনেই ফিরছে। বলছে ভাইছেলেমেয়েদের স্কুলের খরচবাসাভাড়াচাল-ডালের দামসব মিলে মাছ কেনা এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে।’”

রাজধানীর বাজারে দাম বেড়েছে মাছের

বিশেষ করে রুইকাতলাবোয়ালএসব দেশি মাছের দাম গত এক মাসেই কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০১৫০ টাকা। খুচরা বাজারে রুই এখন ৫৫০৬৫০ টাকাকাতলা ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। রশিদের ভাষায়, “এই দামে মানুষ চাইলেও কিনতে পারে না। আমিও কম দামে বিক্রি করতে পারি নাকারণ পাইকারি বাজারেই তো দাম বেশি।

সংসারে টানাপোড়েন

মাছ বিক্রেতা রশিদের সংসারে আছেন স্ত্রীএক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়েছেলেটা মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। রশিদের চোখে হতাশা: মেয়ের স্কুলের ফি জমেছে দুই মাসের। দোকানের আয় দিয়ে আগে সংসার চালাতামবাচ্চাদের পড়াশোনাও চলতোকিছু সঞ্চয়ও হতো। এখন মাস শেষে হিসাব মিলাতে পারি না।

স্ত্রী আগে বাড়িতে হাতের কাজ করতেন। সেসব বন্ধ হয়ে গেছে খরচের চাপে। রশিদ নিজেও মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে ঢাকায় মাছ এনে বিক্রির চেষ্টা করেনযাতে দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু পরিবহন খরচবরফবাজার ফিসব মিলিয়ে লাভ তো হয়ই নাউল্টো কিছু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়।

ডিম দিয়ে মুসুর ডালের রেসিপি দারুণ হিট গরম ভাত রুটি সবেতেই এক্কেবারে ফিট Dim Diye Musur Dal Recipe - YouTube

ভাঙছে মনতবুও লড়াই

রশিদ বলেন, “অনেক দিন হয় ভাতের সঙ্গে মাছ খাওয়া হয়নি। আমি তো মাছ বিক্রি করিকিন্তু আমার ঘরেই এখন ডিম বা ডালেই দিন চলে যায়। কী আশ্চর্যনামাছ বিক্রেতার ঘরেই মাছ নেই!

বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে কিছু পাইকারএই অভিযোগও তুললেন তিনি। ওরা দল বেঁধে মাছ কিনে রাখেপরে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমি চাইলে ওদের সঙ্গে পারি না। তাই আমার মতো খুচরা বিক্রেতারা সব দিশেহারা।

সরকারের দিকে তাকিয়ে

সরকারি নজরদারির ঘাটতির কথাও বললেন রশিদ। তাঁর মতে, “দাম বেঁধে দিলেই হবে নাকার্যকর মনিটরিং লাগবে। বাজারে যদি ঠিকমতো নজর রাখা হতোতাহলে এত অস্বাভাবিক দাম হতো না। সাধারণ মানুষও মাছ কিনতে পারতোআমাদেরও ব্যবসা চলতো।

রুই-কাতলের দামে মাথায় হাত ক্রেতাদের

আশার আলো কোথায়?

তবে রশিদ হাল ছাড়েননি। প্রতিদিনই দোকান খুলেনআশায় থাকেনআজ হয়তো বিক্রি ভালো হবে। সরকারি সাহায্যের কোনো খোঁজ পাননি তিনি। এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিটের পথেও হাঁটেননি। তাঁর কথা, “ঋণ নিয়ে কী করবোবিক্রি না হলে ঋণও শোধ হবে না। আমি চাই বাজারটা একটু স্থিতিশীল হোকমানুষ মাছ কিনুকআবার সেই পুরনো দিনের মতো হোক দোকানের ব্যস্ততা।

ক্লান্ত বাজারের মানুষ

এই প্রতিবেদন এক রশিদের গল্প হলেওঢাকার প্রতিটি বাজারে আছে এমন শত শত মাছ বিক্রেতাযারা এখন জীবনযুদ্ধে হার মানছেন নাকিন্তু ক্লান্ত। মাছ আমাদের জাতীয় খাবারের অংশঅথচ সেটাই আজ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই সংকট শুধু একটি পেশার নয়বরং বৃহত্তর সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য এক জরুরি সংকেতমানুষ আর মাছের এই দূরত্ব যেন চিরস্থায়ী না হয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

শহরের স্পন্দনে কুপ্রা: সিটি গ্যারেজে বদলে যাচ্ছে নগর সংস্কৃতির মানচিত্র

মানুষ আর মাছের দূরত্ব: এক মাছ বিক্রেতার জীবনের লড়াই

১১:৩৭:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

মাছ বিক্রেতা রশিদের সকাল

সকাল সাতটা বাজে। পুরান ঢাকার এক প্রান্তে মাছের বাজারে হট্টগোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন আবদুর রশিদ। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। মাছের দোকানটা তাঁর বাবার আমলে শুরু হয়েছিলএখন নিজেই চালান। হাতে ছুরিসামনে বরফে ঢাকা কিছু রুইকাতলা আর পাঙ্গাস মাছ। একসময় দিনে ২০২৫ কেজি মাছ বিক্রি করতেন তিনি। এখন সেখানে আটকে গেছেন ৭৮ কেজিতে। মাছের দাম যে হারে বেড়েছেতাতে সাধারণ মানুষ দূরে থাকছোট রেস্তোরাঁগুলো পর্যন্ত আগের মতো নিচ্ছে না।

ক্রেতা কমছেকষ্ট বাড়ছে

রশিদ বলছিলেন, “আগে ভোরবেলায় দোকান খুলতেই ভিড় লেগে যেত। এখন ১০টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একজন ক্রেতার আশায়। যে পরিবার আগে ২ কেজি রুই কিনতোএখন আধা কেজি কিনেই ফিরছে। বলছে ভাইছেলেমেয়েদের স্কুলের খরচবাসাভাড়াচাল-ডালের দামসব মিলে মাছ কেনা এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে।’”

রাজধানীর বাজারে দাম বেড়েছে মাছের

বিশেষ করে রুইকাতলাবোয়ালএসব দেশি মাছের দাম গত এক মাসেই কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০১৫০ টাকা। খুচরা বাজারে রুই এখন ৫৫০৬৫০ টাকাকাতলা ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। রশিদের ভাষায়, “এই দামে মানুষ চাইলেও কিনতে পারে না। আমিও কম দামে বিক্রি করতে পারি নাকারণ পাইকারি বাজারেই তো দাম বেশি।

সংসারে টানাপোড়েন

মাছ বিক্রেতা রশিদের সংসারে আছেন স্ত্রীএক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়েছেলেটা মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। রশিদের চোখে হতাশা: মেয়ের স্কুলের ফি জমেছে দুই মাসের। দোকানের আয় দিয়ে আগে সংসার চালাতামবাচ্চাদের পড়াশোনাও চলতোকিছু সঞ্চয়ও হতো। এখন মাস শেষে হিসাব মিলাতে পারি না।

স্ত্রী আগে বাড়িতে হাতের কাজ করতেন। সেসব বন্ধ হয়ে গেছে খরচের চাপে। রশিদ নিজেও মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে ঢাকায় মাছ এনে বিক্রির চেষ্টা করেনযাতে দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু পরিবহন খরচবরফবাজার ফিসব মিলিয়ে লাভ তো হয়ই নাউল্টো কিছু টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যায়।

ডিম দিয়ে মুসুর ডালের রেসিপি দারুণ হিট গরম ভাত রুটি সবেতেই এক্কেবারে ফিট Dim Diye Musur Dal Recipe - YouTube

ভাঙছে মনতবুও লড়াই

রশিদ বলেন, “অনেক দিন হয় ভাতের সঙ্গে মাছ খাওয়া হয়নি। আমি তো মাছ বিক্রি করিকিন্তু আমার ঘরেই এখন ডিম বা ডালেই দিন চলে যায়। কী আশ্চর্যনামাছ বিক্রেতার ঘরেই মাছ নেই!

বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে কিছু পাইকারএই অভিযোগও তুললেন তিনি। ওরা দল বেঁধে মাছ কিনে রাখেপরে দাম বাড়িয়ে দেয়। আমি চাইলে ওদের সঙ্গে পারি না। তাই আমার মতো খুচরা বিক্রেতারা সব দিশেহারা।

সরকারের দিকে তাকিয়ে

সরকারি নজরদারির ঘাটতির কথাও বললেন রশিদ। তাঁর মতে, “দাম বেঁধে দিলেই হবে নাকার্যকর মনিটরিং লাগবে। বাজারে যদি ঠিকমতো নজর রাখা হতোতাহলে এত অস্বাভাবিক দাম হতো না। সাধারণ মানুষও মাছ কিনতে পারতোআমাদেরও ব্যবসা চলতো।

রুই-কাতলের দামে মাথায় হাত ক্রেতাদের

আশার আলো কোথায়?

তবে রশিদ হাল ছাড়েননি। প্রতিদিনই দোকান খুলেনআশায় থাকেনআজ হয়তো বিক্রি ভালো হবে। সরকারি সাহায্যের কোনো খোঁজ পাননি তিনি। এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিটের পথেও হাঁটেননি। তাঁর কথা, “ঋণ নিয়ে কী করবোবিক্রি না হলে ঋণও শোধ হবে না। আমি চাই বাজারটা একটু স্থিতিশীল হোকমানুষ মাছ কিনুকআবার সেই পুরনো দিনের মতো হোক দোকানের ব্যস্ততা।

ক্লান্ত বাজারের মানুষ

এই প্রতিবেদন এক রশিদের গল্প হলেওঢাকার প্রতিটি বাজারে আছে এমন শত শত মাছ বিক্রেতাযারা এখন জীবনযুদ্ধে হার মানছেন নাকিন্তু ক্লান্ত। মাছ আমাদের জাতীয় খাবারের অংশঅথচ সেটাই আজ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এই সংকট শুধু একটি পেশার নয়বরং বৃহত্তর সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য এক জরুরি সংকেতমানুষ আর মাছের এই দূরত্ব যেন চিরস্থায়ী না হয়।