শ্রীলঙ্কা আজ একাধিক সংকটের চাপে দিশাহারা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস, দীর্ঘদিনের ঋণ সংকট আর রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি—সব মিলিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কঠিন পরীক্ষার মুখে প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমারা দিসানায়েকে। নিউজউইককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এই সংকট তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক ঋণ কাঠামো নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দেশ, পুনর্গঠনের পাহাড়সম কাজ
নভেম্বরের শেষ দিকে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় দ্বিত্বাহে শ্রীলঙ্কায় প্রাণ হারান ছয় শতাধিক মানুষ, গৃহহীন হন হাজারো পরিবার। প্রেসিডেন্টের ভাষায়, ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে এবং এটি দ্বীপদেশটির ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ঋণ পরিশোধের চাপের মধ্যেই এখন জলবায়ু দুর্যোগ থেকে দেশ গড়ে তুলতে হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
ঋণ পুনর্গঠন সত্ত্বেও নতুন সংকট
দিসানায়েকে জানান, সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ঐতিহাসিক ঋণ পুনর্গঠন সম্পন্ন করেছে। প্রায় পঁচিশ বিলিয়ন ডলার ঋণ পুনর্গঠিত হয়েছে, তিন বিলিয়ন ডলার মওকুফও মিলেছে। কিন্তু তার পরপরই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সেই সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। তার মতে, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ঋণ টেকসই কাঠামো বদলানো না গেলে এ ধরনের সংকট বারবার ফিরে আসবে।
ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট জানান, ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রথম সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। পাকিস্তান ও মালদ্বীপ থেকেও সহযোগিতা আসে। তিনি স্পষ্ট করেন, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে শ্রীলঙ্কা কোনো ভারসাম্যের খেলায় দেখে না। সবার সঙ্গে কাজ করার লক্ষ্য একটাই—শ্রীলঙ্কার মানুষের জন্য ভালো ভবিষ্যৎ গড়া।
-6933dee6a0f12.jpg)
জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তির আহ্বান
দিসানায়েকে বলেন, শ্রীলঙ্কা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে নগণ্য অবদান রাখে, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ আঘাত সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয় তাদেরই। তাই তিনি উন্নত দেশগুলোর কাছে জলবায়ু অর্থায়ন, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, টেকসই অবকাঠামো ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্দর, লজিস্টিকস, ডিজিটাল অবকাঠামো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহও প্রকাশ করেন তিনি।
চীনা প্রকল্প ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
চীনের ঋণ নিয়ে ‘ঋণফাঁদ কূটনীতি’র অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বলেন, শ্রীলঙ্কায় কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটির অনুমতি নেই এবং থাকবে না। হাম্বানটোটা বন্দর ও পোর্ট সিটি মূলত বাণিজ্যিক প্রকল্প, যা কর্মসংস্থান ও রাজস্ব সৃষ্টি করবে। তবে এসব প্রকল্পে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কড়া নজরদারি থাকবে।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও সংস্কারের অঙ্গীকার
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনও তাজা শ্রীলঙ্কায়। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দিসানায়েকের সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও অনলাইন নিরাপত্তা আইনের মতো দমনমূলক বিধান সংস্কারে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। দুর্নীতি দমনে শুধু গ্রেপ্তার নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনই টেকসই সমাধান—এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবিলায় নতুন পরিকল্পনা
ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন, উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সরঞ্জাম মজুত ও ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চল চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্টের ভাষায়, এখনই ব্যবস্থা না নিলে শ্রীলঙ্কা বারবার একই চক্রে আটকে পড়বে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















