সবুজ রঙের একটি সামরিক অ্যাম্বুলেন্স যখন একটি একতলা গ্রামীণ হাসপাতালের চত্বরে ঢুকছিল, তখন কাছাকাছি থাই সেনা অবস্থান থেকে আসা একের পর এক গোলাবর্ষণের শব্দ দেরি সকালের নীরবতা ভেঙে দেয়। সাদা দেয়ালের ভবনগুলোর জানালা কেঁপে ওঠে। ছাদের কিনারায় বসে থাকা এক ঝাঁক কবুতর উড়ে যায়।
এ দৃশ্য আবারও মনে করিয়ে দেয়, থাই ও কম্বোডীয় সেনাদের মধ্যে বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে চলমান সংঘর্ষের সামনের সারি থেকে হাসপাতালটি কতটা কাছে। সুরিন প্রদেশের ফানম দং রাক জেলায় সদ্য কাটা ধানক্ষেত ঘেরা একটি গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত এই হাসপাতালটি কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা বিশের কোঠার আহত সৈনিকটি ছিল সাম্প্রতিকতম হতাহত।
থানাপন চাইওরাকুলের মতো সামরিক চিকিৎসকদের জন্য এটি নতুন কিছু নয়। থাই সেনাবাহিনী দখলে নেওয়া ত্রিশ শয্যার এই হাসপাতালটি গত সাত ডিসেম্বর থেকে আহতদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে, যখন দুই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। গত দুই সপ্তাহে থানাপন ও তাঁর দল যে প্রায় তিনশো আহত সৈনিকের চিকিৎসা করেছেন, তাঁদের প্রায় আশি শতাংশই কাছাকাছি লড়াইয়ে আহত। এই লড়াই হচ্ছে তা ক্বাই নামের প্রাচীন বালুকাপাথরের খেমার হিন্দু মন্দির এবং এর কাছেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনশো পঞ্চাশ মিটার উঁচু একটি পাহাড় দখলকে কেন্দ্র করে, যা পরিচিত হিল তিনশো পঞ্চাশ নামে।
এই দুটি স্থানই সুরিন প্রদেশের সীমান্তবর্তী ফানম দং রাক জেলার ঘন জঙ্গল ও দুর্গম ভূখণ্ডে অবস্থিত।

সবুজ চিকিৎসা পোশাকের ওপর সাদা কোট পরে থানাপন বলেন, আহতদের শরীরে শ্রাপনেল, গুলির ক্ষত ও বোমার আঘাত রয়েছে। প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। কম্বোডিয়ার রকেট কাছাকাছি পড়েছে, তাই রোগীদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য পেছনে একটি বাংকার তৈরি করা হয়েছে।
গত দুই সপ্তাহের লড়াই শেষে থাই সেনাদের আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচশো চুয়াল্লিশে, যা পুরো আটশো কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে সংঘর্ষের তীব্রতারই প্রতিফলন। নিহতের সংখ্যাও একই চিত্র তুলে ধরে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে নিহত একুশজন থাই সেনার বেশিরভাগই তা ক্বাই ও হিল তিনশো পঞ্চাশ এলাকায় সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন বলে মাঠপর্যায়ে কর্মরত থাই সামরিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এই পরিসংখ্যান স্বাধীন থাই নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠা একটি ধারণাকেই সমর্থন করে। তাঁদের মতে, তুলনামূলকভাবে দুর্বল কম্বোডীয় বাহিনীর কাছ থেকেও থাই সেনাবাহিনীকে এবার উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে।
থাই সামরিক রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে লেখা ‘এ সোলজার কিং’ বইয়ের লেখক সুপালাক গানজানাখুন্ডি বলেন, এবার কম্বোডীয়রা থাইদের বড় ধরনের অভিযানের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং তারা থাই সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তারা জানত, থাই বাহিনী তা ক্বাই ও হিল তিনশো পঞ্চাশ পুনর্দখলকে কৌশলগত বিজয় হিসেবে নিতে চায়।
কম্বোডিয়া এখনো তাদের সামরিক হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে থাই কর্মকর্তাদের ধারণা, শুধু নিহতের সংখ্যাই শতাধিক হতে পারে।
সংঘর্ষের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে থাই সেনাবাহিনী এই দুই এলাকায় বিজয়ের ঘোষণা দেয়। পনেরো ডিসেম্বর আট দিনের লড়াই শেষে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্বতন্ত্র মিনারবিশিষ্ট তা ক্বাই মন্দির থাই বাহিনীর দখলে আসে। এরপর শনিবার বিশ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা দ্বিতীয় সেনা অঞ্চলের কমান্ডার ঘোষণা দেন, কম্বোডীয় সামরিক অবস্থান প্রতিহত করে অবশেষে হিল তিনশো পঞ্চাশও দখল করা হয়েছে।
তবে সোমবার আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ এখনো দূরের। হাজার হাজার গ্রামবাসীর জীবন ইতোমধ্যে বিপর্যস্ত। ধান ও কাসাভা চাষি এবং রাবার সংগ্রাহক এই মানুষগুলোকে সংঘর্ষের দ্বিতীয় দিনেই ঘর ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্দিরে গড়ে তোলা অস্থায়ী শিবিরে।
মাদুর পেতে গাদাগাদি করে দিন কাটাতে কাটাতে তাঁদের মনে ভর করেছে আয়ের অনিশ্চয়তা, বকেয়া ঋণ আর গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ফাঁকা বাড়ির দুশ্চিন্তা। গত পাঁচ মাসে এটি তাঁদের দ্বিতীয়বারের মতো এমন জীবন। জুলাইয়ের শেষ দিকে পাঁচ দিনের সংঘর্ষের সময়ও তাঁরা এলাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধবিরতি পরে নভেম্বরে স্থগিত করে থাইল্যান্ড, যখন স্থলমাইনে সেনারা পঙ্গু হন।
চল্লিশ বছর বয়সী রাবার ও হাঁসচাষি সুথিনান প্রাকাইকেউ বলেন, আমাদের পিকআপ গাড়ির ঋণ বাবদ এখনো এক লাখ পঞ্চাশ হাজার বাথ পরিশোধ করতে হবে। তিনি স্বামী ও কিশোর ছেলের পাশে বসে বলেন, জুলাইয়ের সেই যুদ্ধবিরতি আমাদের কাছে তেমন অর্থবহ ছিল না, কারণ আমরা অনুভব করেছিলাম লড়াই আবার শুরু হবে।

সুরিন ও পার্শ্ববর্তী সিসাকেত প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় পরিত্যক্ত গ্রামের দৃশ্য এখন সাধারণ। এসব গ্রামের বেশিরভাগই সীমান্তের ওপার থেকে কম্বোডিয়ার সোভিয়েত নকশার বহু নলবিশিষ্ট রকেট লঞ্চারের গোলার আওতায়। কিছু গ্রামে রাতে কম্বোডিয়ার ড্রোনও দেখা গেছে বলে জানান গ্রামপ্রধান কেম্পর্ন পেংচান। তাঁর ভাষায়, কোনো কোনো রাতে সেগুলো আকাশে তারার ঝাঁকের মতো লাগে।
সংঘর্ষ পুনরায় শুরু হওয়ার পর তিপ্পান্ন বছর বয়সী কেম্পর্ন ও তাঁর সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক দলকে সিসাকেতের সামনের সারির কাছে প্রধান সড়ক রুট দুইশো একুশে একটি চেকপোস্টে মোতায়েন করা হয়েছে। তাঁরা এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক কারফিউ কার্যকর করছেন, যাতে ঘরে ঘুরে আসা বাস্তুচ্যুত গ্রামবাসীরা সন্ধ্যার মধ্যে আবার অস্থায়ী আশ্রয়ে ফিরে যান।
এই ব্যারিকেডের পরের গ্রামগুলোতে কম্বোডীয় রকেট হামলার স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। একটি গ্রামে, যা আগেই খালি করা হয়েছিল, সম্প্রতি দুটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাতাসে এখনো পোড়া কাঠ ও ছাইয়ের গন্ধ। একটি ধ্বংস হওয়া ঘরে কাঠের বিম থেকে ঝুলে ছিল শিশুদের জামাকাপড়, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল আরও কিছু কাপড় ও চারটি কুঁচকে যাওয়া বালিশ।
কাছাকাছি আরেকটি গ্রামেও গত সপ্তাহে একটি গোলা আঘাত হানে। তা একটি কাঁচা সড়কে পড়লেও বিস্ফোরণের শ্রাপনেলে কাছের কলাবাগানে থাকা তেষট্টি বছর বয়সী এক কৃষকের মৃত্যু হয়।

স্টাফ রাইটার 



















