পুণে থেকে প্রতিদিন বিশ্বের কোটি কোটি শিশুকে সুরক্ষা দিচ্ছে এমন এক টিকা, যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম বহু মানুষই জানেন না। ভারতের পুণেতে গড়ে ওঠা সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ছয় দশক আগে সাইরাস পুনাওয়ালার হাত ধরে শুরু হওয়া এই সংস্থা এখন তাঁর ছেলে আদর পুনাওয়ালার নেতৃত্বে একশ সত্তরেরও বেশি দেশে টিকা পাঠাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য জীবন রক্ষাকারী টিকাকে সহজলভ্য করা।
বিশ্বব্যাপী টিকা উৎপাদনের মেরুদণ্ড
পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষে থাকলেও সিরাম ইনস্টিটিউট কেবল সংখ্যার গল্প নয়। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই উদ্ভাবনকে নীতির কেন্দ্রে রেখেছে। কম খরচে কার্যকর বিকল্প টিকা তৈরি এবং ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় নতুন প্রজন্মের টিকার উন্নয়ন তাদের মূল শক্তি। সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক জোটের সঙ্গে যৌথভাবে বার্ড ফ্লু টিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তারা, যা প্রয়োজনে দ্রুত মানুষের জন্য উপযোগী করা যাবে।
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু মতো রোগের ক্ষেত্রেও কম খরচে টিকা ও চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থনে স্বল্প মূল্যের ম্যালেরিয়া টিকা সরবরাহ করেছে সিরাম। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও ব্যয় কমানোর লক্ষ্যেই গবেষণা চলছে।
নীতির প্রশ্নে আপস নয়
করোনা মহামারির সময় গোটা বিশ্ব যখন টিকার জন্য নির্ভর করছে সিরাম ইনস্টিটিউটের ওপর, তখনও তারা দামের প্রশ্নে আপোষ করেনি। প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, সে সময় টিকার দাম কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব ছিল। কিন্তু নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য ডোজ প্রতি মূল্য সীমিত রাখা হয়। এর পেছনে ছিল প্রতিষ্ঠানের মূল দর্শন, উদ্ভাবন কখনো মানবতার বিপক্ষে যেতে পারে না।

শুরুটা ছিল ঘোড়ার খামার থেকে
বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সাইরাস পুনাওয়ালা যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা আজও অনেকের কাছে বিস্ময়। পারিবারিক ঘোড়া প্রজননের ব্যবসা থেকেই আসে সেই অনুপ্রেরণা। এক পশু চিকিৎসকের সঙ্গে কথোপকথনে জানা যায়, আমদানিকৃত টিকার দাম সরকারের নাগালের বাইরে। সেই শূন্যতা দেখেই পরিবারের কিছু ঘোড়া বিক্রি করে ভাই জাভেরির সঙ্গে মিলে শুরু হয় অ্যান্টি টিটেনাস টিকা উৎপাদন। এরপর ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ও হুপিং কাশির যৌথ টিকা এবং হাম টিকার মাধ্যমে দ্রুত বিস্তৃতি পায় প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্ব বাজারে প্রবেশের পথে আন্তর্জাতিক মান পূরণ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইউনিসেফ সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্য টিকা সরবরাহ শুরু হয়। বর্তমানে সিরাম ইনস্টিটিউটের প্রায় আশি শতাংশ বিক্রি বৈশ্বিক অংশীদারদের কাছে যায়, যা নতুন উদ্ভাবন ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর জ্বালানি জোগায়।
উদ্ভাবন শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়
সিরাম ইনস্টিটিউটে উদ্ভাবন মানে কেবল নতুন টিকা নয়, বরং পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন। একসময় হাতে হাতে পরীক্ষা করা শিশি এখন একসঙ্গে একাধিক ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হয়, ফলে ভুল কমে এবং নিরাপত্তা বাড়ে। ছোট ব্যাচে তৈরি হওয়া টিকা এখন সেল ফ্যাক্টরির মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদিত হচ্ছে, মান বজায় রেখেই।
আফ্রিকায় উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং উন্নয়নশীল দেশের টিকা প্রস্তুতকারকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতাও তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংস্কৃতির মঞ্চে ভারতের গল্প
টিকার বাইরেও পুনাওয়ালা পরিবার ভারতের বৈশ্বিক পরিচয় গড়তে সক্রিয়। নাতাশা পুনাওয়ালা আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের মঞ্চে ভারতীয় নকশা ও কারুশিল্প কে তুলে ধরেছেন নতুনভাবে। অন্যদিকে আদর পুনাওয়ালা চলচ্চিত্র প্রযোজনায় যুক্ত হয়ে ভারতীয় গল্পকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ভবিষ্যতে তারা কোন পথে এগোবে, তা সময়ই বলবে। তবে স্পষ্ট, টিকা ও সংস্কৃতি—দুই ক্ষেত্রেই উদ্ভাবনের শক্তিকে হাতিয়ার করে সিরাম ইনস্টিটিউট ও পুনাওয়ালা পরিবার ভারতের বৈশ্বিক প্রভাব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।
#সিরামইনস্টিটিউট #ভারতেরটিকাশিল্প #বিশ্বস্বাস্থ্য #টিকাউদ্ভাবন #পুনাওয়ালাপরিবার #গ্লোবালস্বাস্থ্য #মানবতারজন্যবিজ্ঞান
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















