প্রত্যাশার চেয়েও দৃঢ় অর্থনৈতিক সহনশীলতা
২০২৫ সালে বৈশ্বিকভাবে শুল্ক বৃদ্ধির ঢেউ বয়ে গেলেও, বিস্ময়করভাবে অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। বিশ্লেষকেরা ভাবছিলেন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা হয়তো বিশ্ব অর্থনীতিকে থমকে দেবে। কিন্তু ব্যবসা ও পরিবারগুলো তা সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।
জেপি মর্গানের তথ্যমতে, বছরের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
শুল্ক এড়াতে চালাকি ও ব্যবসায়িক কৌশল
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি পণ্য পাঠানোর পরিবর্তে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে রপ্তানি করছে যাতে কম শুল্ক পড়ে। একই সঙ্গে, অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ভোক্তা ব্যয় ও বিনিয়োগে স্থবিরতা আসেনি।
গোল্ডম্যান স্যাকস জানায়, বিনিয়োগ, উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান, ভোগব্যয় ও সামগ্রিক কার্যক্রম সবই ভালো অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯ থেকে শেখা কৌশল কাজে আসছে
করোনা মহামারির সময় অনেক কোম্পানি সরবরাহ চেইন সুরক্ষিত করতে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা এখন সুফল দিচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো দেশগুলো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে বাজারে আস্থা তৈরি করছে।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকস-এর অর্থনীতিবিদ অ্যাঞ্জেল তলাভেরা বলেন, অনেক কোম্পানি ভবিষ্যতে শুল্ক আরও বাড়বে ধরে নিয়ে এখনই মজুদ বাড়াচ্ছে।
বিশ্বায়নবিরোধী রাজনীতি ও উৎপাদনের স্থানান্তর
গত দশকে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই বহু আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্থানীয় উৎপাদনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। শুল্ক সংকট তা আরও দৃঢ়ভাবে সামনে এনেছে।
উদাহরণ হিসেবে জার্মান ফ্যান প্রস্তুতকারী কোম্পানি ইবিএম প্যাপস্ট যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। প্রধান নির্বাহী ক্লাউস গেইসডর্ফার জানান, যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি-ভিত্তিক ডেটা সেন্টার নির্মাণে চাহিদা বাড়ছে, যা তাদের আয় ২০-৩০ শতাংশ বাড়াতে সাহায্য করবে।
বিশ্ব বাণিজ্য ও উৎপাদনে ইতিবাচক গতি
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) জানায়, বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্ব পণ্য বাণিজ্য ৫.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। ফলে পূর্বের ০.২ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস পরিবর্তন করে সংস্থাটি এখন ০.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অনুমান করছে।
ইউরোপেও উৎপাদন খাতে অগ্রগতি দৃশ্যমান। নতুন অর্ডার, রপ্তানি এবং উৎপাদন সূচক তিন বছর পর সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ইউরোপের গাড়ি শিল্প ২৫ শতাংশ শুল্ক থাকা সত্ত্বেও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকস-এর আদ্রিয়ান প্রেটেজন জানান, আগে থেকে মাল মজুদ ও শুল্কের চাপ ইউরোপীয় রপ্তানিকে কিছুটা চাপ দিলেও বড় ধরনের পতনের সম্ভাবনা কম।
চীনের চমকপ্রদ টিকে থাকা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য কিছুটা কমলেও, চীনের মোট রপ্তানি ৬ শতাংশ বেড়েছে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোতে চীনা পণ্য পাঠানো বেড়েছে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মেক্সিকোতে রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও ব্যবসাগুলোর ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ নিট সম্পদের কারণে শুল্কের কিছু খরচ তারা বহন করতে সক্ষম হচ্ছে।
সতর্কতাও রয়েছে
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বর্তমানে বাণিজ্যে যে দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে, তা ভবিষ্যতে কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। কিছু কোম্পানি অগ্রিম পণ্য কিনে ফেলেছে, ফলে পরবর্তী সময়ে কিনতে কম আগ্রহী হতে পারে।
পিটারসন ইনস্টিটিউটের মার্কাস নোল্যান্ড বলেন, তৎক্ষণাৎ ধাক্কা না লাগলেও সময়ের সঙ্গে প্রভাব পড়তে পারে। যেমন ব্রেক্সিট সরাসরি ধাক্কা না দিলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্রিটিশ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
নোল্যান্ড আরও বলেন, শুল্কের মাত্রাও গুরুত্বপূর্ণ। সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক দিলে অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব নাও পড়তে পারে। কিন্তু ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের মতো উচ্চ শুল্ক হলে তা আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্ব অর্থনীতি এখনো টিকে আছে—নানা জটিলতা ও শুল্কের বেড়াজাল সত্ত্বেও। উৎপাদন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য এগিয়ে চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ভবিষ্যতে এই দৃঢ়তা টেকসই থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে শুল্ক নীতির ধারাবাহিকতা ও বৈশ্বিক চাহিদার ওপর।