বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত একটি জনপ্রিয় ক্যাফেতে বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে জিম্মি করেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি নামের ওই ক্যাফেতে আট থেকে নয়জন সশস্ত্র ব্যক্তি হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি বহু নাগরিককে জিম্মি করে রেখেছে। জিম্মিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি রয়েছেন বলে জানা গেছে।
একটি বন্দুকযুদ্ধে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত এবং অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের এক মুখপাত্র।
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। আইএসের নিজস্ব বার্তা সংস্থা আমাক-এ এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিদেশিদের প্রিয়” এক রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে। তারা দাবি করেছে, বিভিন্ন দেশের অন্তত ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যদিও এ তথ্যের স্বপক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, তারা জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামলাকারীদের সঙ্গে কথোপকথনের চেষ্টা করছে।
প্রাথমিক খবরে বলা হয়েছে, জিম্মিদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বিদেশি থাকতে পারেন।
ঢাকায় ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা ইতালিয়ান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সাতজন ইতালীয় নাগরিক ওই ক্যাফেতে থাকতে পারেন।
জাপানের সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, জিম্মিদের মধ্যে জাপানি নাগরিকও থাকতে পারেন কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গুলশানের অবস্থান এবং হামলার প্রেক্ষাপট
হোলি আর্টিজান বেকারি অবস্থিত ঢাকার গুলশান এলাকায়, যেখানে কূটনৈতিক মিশন, বিদেশি রেস্তোরাঁ এবং অভিজাত বসতবাড়ি রয়েছে। এই ক্যাফে প্রবাসী, কূটনীতিক এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, হামলার সময় “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি শোনা যায়। রাশিলা রহিম নামের এক বাসিন্দা বলেন, “আমার অঙ্কন কক্ষের কাচ ভেঙে গেছে। আমার খালা, তার মেয়ে এবং দুইজন বন্ধু ইফতারের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু তারা এখনো ফেরেননি। কোথায় আছেন তাও জানি না।”
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা তারিক মীর বলেন, হামলার প্রায় তিন ঘণ্টা পরেও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, “বাইরে বিশৃঙ্খলা চলছে। রাস্তাগুলো বন্ধ। প্রচুর সংখ্যক পুলিশ কমান্ডো উপস্থিত।”
র্যাব প্রধানের বক্তব্য
বাংলাদেশের বিশেষায়িত পুলিশ বাহিনী র্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদ বলেন, “আমরা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে চাই। হামলাকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো ভেতরে আটকে পড়া মানুষের জীবন রক্ষা করা।”
পুলিশ জানায়, স্থানীয় সময় রাত ৯টা ২০ মিনিটে (গ্রিনউইচ সময় দুপুর ১টা ২০) বন্দুকধারীরা হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে গুলি ছোড়ে।
বিশ্লেষণ: অনবরত সহিংসতার নতুন মাত্রা
বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ প্রতিনিধি অন্বরসন এথিরাজন বলেন, “বাংলাদেশে বিদেশিদের জিম্মি করে রাখার ঘটনা এই প্রথম। আগে থেকে একাডেমিক, ব্লগার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বিদেশিদের ওপর এরকম হামলা বিরল। দেশের এক সপ্তাহব্যাপী ঈদ ছুটির ঠিক আগে এই হামলা, যখন অধিকাংশ মানুষ গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার বরাবরই দাবি করে আসছিল যে বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এই হামলা প্রমাণ করলো নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে।”
পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি
ঢাকার একটি হাসপাতাল জানিয়েছে, এ ঘটনায় প্রায় ৩০ জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন।
বন্দুকধারীদের হামলার পর পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে পৌঁছে এলাকাটি ঘিরে ফেলে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাফের চারপাশে অবস্থান করছেন।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক জিল ম্যাকগিভারিং বলেন, বাংলাদেশে বড় পরিসরের গুলি চালনার ঘটনা বিরল হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে যে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার পেছনে ইসলামপন্থি জঙ্গিদের দায়ী করা হয়েছে।
এই হামলা শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা, জঙ্গি হামলার ঝুঁকি এবং দেশের গোয়েন্দা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। জিম্মি সংকট কীভাবে শেষ হবে এবং এর পরিণতি কী দাঁড়াবে, সেটাই এখন পুরো জাতির উদ্বেগের কেন্দ্রে।