০৫:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিকাগোতে সেনা মোতায়েন আটকাল সুপ্রিম কোর্ট, ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতা প্রশ্নের মুখে কুয়েত-চীনের চারশ কোটি ডলারের চুক্তিতে বদলে যাচ্ছে বন্দর ভবিষ্যৎ, জোরালো হবে বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান বোমা আর বাস্তুচ্যুতির মাঝখানে গাজা, ফের ঘরছাড়া হওয়ার আতঙ্কে অবরুদ্ধ মানুষ উত্তর সীমান্তে আকাশজুড়ে আলোর স্তম্ভ বিস্ময়ে মুগ্ধ বাসিন্দারা, বিরল শীতের ইঙ্গিত বিশ্ব কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রিয়াদ: সংঘাত নিরসনে সৌদি আরবের সংজ্ঞায়িত বছর ইয়েমেনে বন্দিবিনিময়ে বড় অগ্রগতি, দুই হাজার নয়শ’ জনের মুক্তিতে সমঝোতা অর্থনীতি টিকে থাকলেও জীবনের চাপে ক্লান্ত আমেরিকা, দুশ্চিন্তায় নতুন বছর রাশিয়ার ভয়াবহ হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো বিপর্যস্ত, শিশুসহ নিহত তিন আবু ধাবি–দুবাইয়ে বিদেশি ইয়ট চলাচল সহজ হচ্ছে জানুয়ারি থেকে কনটেন্ট ব্যয়ে নতুন হিসাব কষছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম

অন্ধকারে দীপ্ত আলোর খোঁজে: এক বিধবার সংগ্রামের কাহিনি

জীবন শুরু আবার, স্বামীর মৃত্যুর পর

ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসবাস রওশন আরার। বয়স পঁইত্রিশ পেরিয়েছে মাত্র, কিন্তু তার মুখের রেখায় জীবনের অনেকটা পথ চলার ক্লান্তি ফুটে আছে। তিন বছর আগে হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী হারান। স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠার আগেই তাকে সামনে দাঁড়াতে হয় নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি—তিনটি সন্তান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর নিঃসঙ্গ জীবনের লড়াই।

সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য মায়ের যুদ্ধ

রওশনের তিন সন্তান—নাবিল (১৩), তামান্না (৯) ও লুবনা (৬)। স্বামীর মৃত্যুর পর একেবারে আয়হীন হয়ে পড়লেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের শিক্ষার খরচ যেভাবেই হোক, চালিয়ে যাবেন। সকালবেলা তিনি গ্রামের হাটে সবজি বিক্রি করেন। দুপুরে স্থানীয় এক প্রাইমারি স্কুলে রান্নার কাজ করেন। আর বিকেলে ঘরে এসে নিজেই সন্তানদের পড়াশোনা দেখেন।

রওশন আরার কথায়, “আমি না খেয়ে থাকলেও মেনে নেব, কিন্তু ওদের লেখাপড়ায় যেন বাধা না আসে। এই স্বপ্নটা ধরে রেখেই বেঁচে আছি।”

সমাজের চোখ রাঙানি ও কুসংস্কারের দেয়াল

একজন একা নারী হিসেবে রওশনকে প্রতিদিনই লড়তে হয় সমাজের কটূ কথা, সন্দেহের চোখ ও অসংখ্য বাধার সঙ্গে। স্বামীহীন নারীর প্রতি গ্রামের কিছু পুরুষের কু-দৃষ্টির পাশাপাশি অনেক নারীও তাঁর সাহসিকতাকে দেখে ঈর্ষা করেন। কেউ বলেন, “একজন বিধবা এত ঘোরাঘুরি করে কেন?”, কেউ আবার সন্তানদের লেখাপড়াকে “অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা” বলে কটাক্ষ করেন।

কিন্তু রওশন বলেন, “আমি জানি, এই সমাজ এক বিধবার উঠে দাঁড়ানো সহজে মেনে নিতে চায় না। কিন্তু আমি থামব না।”

বাতিলের ঝুঁকিতে ২৫৮ এনজিও | প্রথম আলো

সরকারি সহায়তা নেই, এনজিওর দরজাও বন্ধ

তিনি কয়েকবার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাননি। একাধিক এনজিওর দ্বারস্থ হয়েও ফিরে এসেছেন খালি হাতে। “বলে, আমার বয়স কম, এখনও কাজ করতে পারি, তাই সহায়তা পাওয়া যাবে না,” বলেন তিনি। অথচ এই সমাজেই অনেক প্রভাবশালী পরিবার দিনের পর দিন সরকারি সুযোগ ভোগ করছে, যাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রয়োজন নেই।

আশার আলো: গ্রামের কয়েকজন তরুণ ও শিক্ষক

তবে হতাশার মাঝেও কিছু আশার আলো আছে। গ্রামের স্কুলের একজন শিক্ষক, মিজান স্যার, প্রায়ই রওশনের ছেলেমেয়েদের ফ্রি টিউশন দেন। এলাকার দুই তরুণ, জুয়েল ও সাবিনা, স্থানীয়ভাবে ছোট একটা “চাইল্ড সাপোর্ট ফান্ড” গড়ে তুলেছেন, যেখানে গ্রামের কিছু যুবক মাসে ২০-৩০ টাকা করে দিয়ে রওশনের মতো সংগ্রামী অভিভাবকদের সহায়তা করেন।

“রওশন আপা আমাদের চোখে একজন আসল হিরো,” বলেন জুয়েল।

এখনও কি সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ হয়! | The Business Standard

প্রতিজ্ঞা: সন্তানদের মানুষ করেই মরব

রওশন প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে ঘরের কোণে বসে সেলাইয়ের কাজ করেন। এটাই তার শেষ অবলম্বন—পৃথিবীর দিকে তিনটি শিশুকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা। “ওদের মানুষ করেই মরব। তবেই এই জীবনের কষ্ট স্বার্থক হবে,”—রওশনের কথায় দৃঢ় সংকল্প।

একটি প্রশ্ন রেখে যাই

আজ যখন সমাজ নারী ক্ষমতায়নের কথা বলে, তখন গ্রামবাংলার হাজারো রওশন আরা অবহেলিত থেকে যান কেবল বিধবা হওয়ার কারণে। এই বৈষম্য ভাঙবে কে? রাষ্ট্র, সমাজ, না আমরা—এই প্রশ্ন আমাদের সবার জন্য রেখে যান রওশন আরারা।

এই প্রতিবেদনটি একটি বাস্তবিক চিত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যেখানে নাম ও স্থান আংশিক পরিবর্তিত হয়েছে গোপনীয়তার স্বার্থে।

জনপ্রিয় সংবাদ

শিকাগোতে সেনা মোতায়েন আটকাল সুপ্রিম কোর্ট, ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতা প্রশ্নের মুখে

অন্ধকারে দীপ্ত আলোর খোঁজে: এক বিধবার সংগ্রামের কাহিনি

০৪:১০:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

জীবন শুরু আবার, স্বামীর মৃত্যুর পর

ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসবাস রওশন আরার। বয়স পঁইত্রিশ পেরিয়েছে মাত্র, কিন্তু তার মুখের রেখায় জীবনের অনেকটা পথ চলার ক্লান্তি ফুটে আছে। তিন বছর আগে হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী হারান। স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠার আগেই তাকে সামনে দাঁড়াতে হয় নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি—তিনটি সন্তান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর নিঃসঙ্গ জীবনের লড়াই।

সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য মায়ের যুদ্ধ

রওশনের তিন সন্তান—নাবিল (১৩), তামান্না (৯) ও লুবনা (৬)। স্বামীর মৃত্যুর পর একেবারে আয়হীন হয়ে পড়লেও তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সন্তানদের শিক্ষার খরচ যেভাবেই হোক, চালিয়ে যাবেন। সকালবেলা তিনি গ্রামের হাটে সবজি বিক্রি করেন। দুপুরে স্থানীয় এক প্রাইমারি স্কুলে রান্নার কাজ করেন। আর বিকেলে ঘরে এসে নিজেই সন্তানদের পড়াশোনা দেখেন।

রওশন আরার কথায়, “আমি না খেয়ে থাকলেও মেনে নেব, কিন্তু ওদের লেখাপড়ায় যেন বাধা না আসে। এই স্বপ্নটা ধরে রেখেই বেঁচে আছি।”

সমাজের চোখ রাঙানি ও কুসংস্কারের দেয়াল

একজন একা নারী হিসেবে রওশনকে প্রতিদিনই লড়তে হয় সমাজের কটূ কথা, সন্দেহের চোখ ও অসংখ্য বাধার সঙ্গে। স্বামীহীন নারীর প্রতি গ্রামের কিছু পুরুষের কু-দৃষ্টির পাশাপাশি অনেক নারীও তাঁর সাহসিকতাকে দেখে ঈর্ষা করেন। কেউ বলেন, “একজন বিধবা এত ঘোরাঘুরি করে কেন?”, কেউ আবার সন্তানদের লেখাপড়াকে “অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা” বলে কটাক্ষ করেন।

কিন্তু রওশন বলেন, “আমি জানি, এই সমাজ এক বিধবার উঠে দাঁড়ানো সহজে মেনে নিতে চায় না। কিন্তু আমি থামব না।”

বাতিলের ঝুঁকিতে ২৫৮ এনজিও | প্রথম আলো

সরকারি সহায়তা নেই, এনজিওর দরজাও বন্ধ

তিনি কয়েকবার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো কোনো সাড়া পাননি। একাধিক এনজিওর দ্বারস্থ হয়েও ফিরে এসেছেন খালি হাতে। “বলে, আমার বয়স কম, এখনও কাজ করতে পারি, তাই সহায়তা পাওয়া যাবে না,” বলেন তিনি। অথচ এই সমাজেই অনেক প্রভাবশালী পরিবার দিনের পর দিন সরকারি সুযোগ ভোগ করছে, যাদের প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রয়োজন নেই।

আশার আলো: গ্রামের কয়েকজন তরুণ ও শিক্ষক

তবে হতাশার মাঝেও কিছু আশার আলো আছে। গ্রামের স্কুলের একজন শিক্ষক, মিজান স্যার, প্রায়ই রওশনের ছেলেমেয়েদের ফ্রি টিউশন দেন। এলাকার দুই তরুণ, জুয়েল ও সাবিনা, স্থানীয়ভাবে ছোট একটা “চাইল্ড সাপোর্ট ফান্ড” গড়ে তুলেছেন, যেখানে গ্রামের কিছু যুবক মাসে ২০-৩০ টাকা করে দিয়ে রওশনের মতো সংগ্রামী অভিভাবকদের সহায়তা করেন।

“রওশন আপা আমাদের চোখে একজন আসল হিরো,” বলেন জুয়েল।

এখনও কি সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ হয়! | The Business Standard

প্রতিজ্ঞা: সন্তানদের মানুষ করেই মরব

রওশন প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে ঘরের কোণে বসে সেলাইয়ের কাজ করেন। এটাই তার শেষ অবলম্বন—পৃথিবীর দিকে তিনটি শিশুকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা। “ওদের মানুষ করেই মরব। তবেই এই জীবনের কষ্ট স্বার্থক হবে,”—রওশনের কথায় দৃঢ় সংকল্প।

একটি প্রশ্ন রেখে যাই

আজ যখন সমাজ নারী ক্ষমতায়নের কথা বলে, তখন গ্রামবাংলার হাজারো রওশন আরা অবহেলিত থেকে যান কেবল বিধবা হওয়ার কারণে। এই বৈষম্য ভাঙবে কে? রাষ্ট্র, সমাজ, না আমরা—এই প্রশ্ন আমাদের সবার জন্য রেখে যান রওশন আরারা।

এই প্রতিবেদনটি একটি বাস্তবিক চিত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যেখানে নাম ও স্থান আংশিক পরিবর্তিত হয়েছে গোপনীয়তার স্বার্থে।