কোয়াড সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে ঘোষণা করেছেন, কোয়াড (QUAD) কেবল নিরাপত্তা জোট নয়, এটি একটি সম্প্রসারিত আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠছে। এর নতুন সম্প্রসারণমূলক উদ্যোগ মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার আরও দেশকে এতে সম্পৃক্ত করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই আলোচনার কেন্দ্রে ইন্দোনেশিয়ার অংশগ্রহণের বিষয়টি যেমন ছিল, তেমনি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাসেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ, যার রয়েছে একটি বিশাল সমুদ্রসীমা, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান—এই সম্প্রসারিত কোয়াড জোটে যোগদান করলে তা কতটা লাভজনক ও যৌক্তিক হবে, তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
কোয়াড কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
QUAD বা Quadrilateral Security Dialogue একটি অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম, যেখানে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া সদস্য হিসেবে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার জন্য গঠিত হলেও বর্তমানে এর কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তি সহযোগিতা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সমুদ্রপথের সুরক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেও বিস্তৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান ও সমুদ্রসীমা
বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় ১,১৮১ কিলোমিটার উপকূলরেখা এবং ১,১৮,৮১৩ বর্গকিমি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক সমুদ্র অঞ্চল। বঙ্গোপসাগরে এই সমুদ্র অঞ্চল শুধু মৎস্যসম্পদ বা প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য নয়, জাহাজ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবেও বিবেচিত। চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর নৌ-সামরিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ এই অঞ্চলে গভীরভাবে জড়িত। ফলে কোয়াডের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে তার নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্ব আরও সুদৃঢ় করতে পারবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য
কোয়াড সম্প্রতি “Blue Dot Network” এবং “Partnership for Quality Infrastructure”-এর মতো প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে অগ্রগামী হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্ল্যাটফর্মে যোগ দিলে—
- সমুদ্রবন্দর,রেল, সড়ক ও বিদ্যুৎ খাতে উচ্চমানের অবকাঠামো বিনিয়োগ পেতে পারে;
- চীনেরBelt and Road Initiative (BRI)–এর একচেটিয়া প্রভাব থেকে কিছুটা ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে;
- টেলিকম,ফাইভ-জি, সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনেও উন্নত সহযোগিতা পেতে পারে।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা: একটি রূপরেখা
কোয়াড সদস্যরা সমুদ্র নিরাপত্তা, মানবিক সাহায্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যৌথ মহড়া পরিচালনা করে থাকে। এই সহযোগিতায় যুক্ত হলে বাংলাদেশ পাবে—
- উন্নত মেরিটাইম নজরদারি প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ;
- কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ;
- বঙ্গোপসাগরে চোরাচালান,জলদস্যুতা ও অবৈধ মৎস্য শিকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরোধ।
বাংলাদেশের মেরিটাইম সুরক্ষা এবং ‘Blue Economy’ বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলগত ভারসাম্য
বাংলাদেশ এতদিন ধরে ‘বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে, শত্রু কারো সঙ্গে নয়’ নীতির আলোকে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রেখেছে। কোয়াডে সম্পৃক্ত হলে—
- পশ্চিমা কৌশলগত জোটগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হবে;
- চীন,ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রা তৈরি হবে;
- দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সক্রিয় ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারবে।
তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব থাকায় কোয়াডে অংশগ্রহণে কিছু কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হতে পারে। তাই একটি সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ পররাষ্ট্র কৌশলের মাধ্যমে তা সামাল দেওয়া জরুরি।
ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য দেশের সাড়া
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেই কোয়াডের সম্প্রসারিত উদ্যোগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এই নতুন পরিসরে যুক্ত হলে—
- আঞ্চলিক নিরাপত্তায় নেতৃত্বের ভূমিকা রাখতে পারবে;
- সমুদ্রপথ ও বাণিজ্যরুটে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অবকাঠামো উন্নয়নের সমর্থন পাবে।
বাংলাদেশ কি যোগ দেবে?
বাংলাদেশ যদি কোয়াডের সম্প্রসারিত প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, তবে অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতিতে তা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে। তবে এতে সফল হতে হলে—
- কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে;
- দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে;
- এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে।
অতএব, কোয়াডে যোগদান একটি বিচক্ষণ ও ভবিষ্যৎমুখী সিদ্ধান্ত হতে পারে, যদি তা বাংলাদেশ নিজের স্বার্থকে সামনে রেখে গ্রহণ করে এবং কার্যকর কৌশলগত প্রস্তুতির মাধ্যমে এগিয়ে যায়।