পুরান ঢাকার গলিপথে ঢুকে শৈশবের গন্ধ
ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে গেলে আপনি হয়তো হুট করে চোখে পড়া কোনো ঝকঝকে দোকানে নয়, বরং পুরনো দিনের কাঠের সাইনবোর্ড, ভাঙাচোরা দরজা, ধোঁয়াভরা চুল্লির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবেন — জানবেন না, এইখানেই লুকিয়ে আছে একটি জীবন্ত ইতিহাস। এই দোকানের নাম ‘প্রিন্স অব ওয়েলস বেকারি’, স্থানীয়দের মুখে মুখে পরিচিত ‘লক্ষ্মী বেকারি’ নামে। নাম যেমনই হোক, স্বাদে ও স্মৃতিতে এটি ঢাকাবাসীর জন্য এক অমূল্য রত্ন।
জন্ম ব্রিটিশ আমলে, স্বাদে বাংলা ছোঁয়া
প্রায় ১৭৫ বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৫০ সাল নাগাদ, এক ওয়েলস (বর্তমান যুক্তরাজ্য) এর বেকার ঢাকা শহরে এসে এই বেকারিটির পত্তন করেন। সে সময় এটিই ছিল ঢাকার প্রথম বেকারি। নাম রাখা হয় ব্রিটিশ রাজপুত্রের নামে—Prince of Wales Bakery।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গেলে সেই ব্রিটিশ বেকার ঢাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর তাঁর সাবেক সহকারী, পুরান ঢাকারই সন্তান শেখ বু্দ্ধু মিয়া দোকানটি কিনে নেন এবং চালিয়ে যেতে থাকেন পুরনো ঐতিহ্য। এখন বেকারিটির তৃতীয় প্রজন্মের উত্তরসূরি মো. বাবুল এর তত্ত্বাবধানে চলছে এই শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান।
শতাব্দীপ্রাচীন চুল্লিতে বানানো কেক
প্রযুক্তি বদলেছে, বাজারে এসেছে আধুনিক ওটেন, ইলেকট্রিক মেশিন। কিন্তু লক্ষ্মী বেকারিতে এখনো লাকড়ির চুল্লিতে কেক, বিস্কুট আর পাউরুটি তৈরি হয় হাতে গড়া ছাঁচে, একেবারে আগের নিয়মে।
বেকারিটির সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম হলো—
- ক্রিম রোল
- ফ্রুট কেক
- প্লেইন পাউরুটি
- শীতকালীন বিশেষ খাজা
- বড়দিনের ডিম-কেক
প্রতিটি আইটেমের স্বাদেই থাকে একটি নস্টালজিয়া, যা পুরান ঢাকার মানুষের শৈশব স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে।
চানাচুর: ঝাল-নোনার জাদু
যদিও কেক, রুটি ও বিস্কুটের জন্য বেকারিটির খ্যাতি বেশি, তবে লক্ষ্মী বেকারির আরেকটি চিরপরিচিত ও জনপ্রিয় পণ্য হলো চানাচুর।
পুরান ঢাকার বহু বাসিন্দার ভাষায়,
“লক্ষ্মী বেকারির চানাচুরে এমন একটা ঝাল-নোনার ব্যালান্স আছে, যা এখনকার চানাচুরে পাওয়া যায় না।”
চানাচুরটি তৈরি হয় মশলা, বাদাম, ভাজা ছোলা, শুঁটকি ঘ্রাণহীন তেল ও ঘরোয়া রেসিপিতে। এর স্বাদে পুরনো ঢাকার মাটি, মানুষের ঘাম আর ঐতিহ্য মিশে আছে। অনেকেই চানাচুর কিনে পরিবারের সদস্যদের জন্য বাড়ি নিয়ে যান, আবার অনেকেই দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে চায়ের সঙ্গে খান।
দোকান নয়, যেন একটা সংগ্রহশালা
প্রিন্স অব ওয়েলস বেকারিতে ঢুকলে মনে হয় সময় থেমে গেছে। কাঠের তাক, পুরনো আয়রন-ওভেন, দেয়ালে ঝুলছে বিবর্ণ সাদাকালো ছবি, আর কোণায় রাখা এক শতাব্দী পুরনো ময়দা মেশানোর হাত-চালিত যন্ত্র। দোকানের ভিতর থেকে বের হওয়া মিষ্টি ও মশলাদার ঘ্রাণ যেন চোখ বুজলেই আপনাকে নিয়ে যাবে ১৯৫০-এর দশকে।
স্কুলপড়ুয়া থেকে নব্বইয়ের বৃদ্ধ: সবার প্রিয় লক্ষ্মী বেকারি
এই বেকারির প্রধান ক্রেতারা একসময় ছিলেন আশেপাশের স্কুলের ছাত্রছাত্রী—সেন্ট গ্রেগরি, নটর ডেম, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার। এখনো স্কুল শেষে অনেকেই এসে দাঁড়ায় এই দোকানের সামনে, কিছু না কিছু কিনে খায়। আশেপাশের বাসিন্দারা বলেন,
“বাজারে হাজার কেক পাওয়া যায়, কিন্তু লক্ষ্মীর কেক আর চানাচুরের মতো ঘ্রাণ ও স্বাদ এখনো কোথাও পাই না।”
বৃদ্ধ খদ্দেররা বলেন,
“এই দোকানের পাউরুটিতে এমন একটা মিষ্টি ঘ্রাণ থাকে, আর চানাচুরে আছে পুরান ঢাকার ঝাঁজ।”
ঐতিহ্যই মূল চালিকাশক্তি, মুনাফা নয়
বর্তমান মালিক মো. বাবুল বলেন,
“আমরা এই দোকান চালাই লাভের জন্য না। চালাই বাবার স্মৃতি আর এই ঐতিহ্যটা ধরে রাখার জন্য। মানুষ যে ভালোবাসে, এই ভালোবাসাটাই আসল পুঁজি।”
তাঁর ভাষায়, এখনো দিনে দিনে ১৫০টির বেশি কেক, ১০০০টির মতো পাউরুটি আর প্রচুর চানাচুর বিক্রি হয়—সবই হাতে বানানো। এ যেন ভালোবাসার কারখানা।
পুরান ঢাকার প্রাণের অংশ
পুরান ঢাকার বাজার, গলিপথ, উৎসবের হাট—সব কিছুরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ লক্ষ্মী বেকারি। বিয়ের কেক থেকে শুরু করে বড়দিনের উৎসব, ঈদের আগের দিন কিংবা হুট করে মজাদার চানাচুরের খোঁজ—এই দোকানে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। এখানকার একটি সাধারণ ক্রিম রোল হয়তো কারো ভালোবাসার প্রথম সাক্ষী, আর চানাচুর হয়তো সন্ধ্যার চায়ের সেরা সঙ্গী।
কীভাবে পৌঁছাবেন
লোকেশন: লক্ষ্মীবাজার, পুরান ঢাকা (বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে হেঁটে ৫ মিনিট)
সময়: সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা
বিশেষ দ্রষ্টব্য: দোকানে কোনো ডিজিটাল মেনু নেই, অর্ডার নিতে হয় কাগজে-কলমে!
শেষ কথা: ঐতিহ্যের ঘ্রাণে মোড়া এক টুকরো মিষ্টি ও ঝাল অতীত
আজ যখন ঢাকার রাস্তায় আধুনিক ক্যাফে আর বেকারির ছড়াছড়ি, তখনও লক্ষ্মী বেকারি নিজেকে ধরে রেখেছে নিঃশব্দে—একটি সময়ের গল্প হয়ে, একটানা পাঁচ প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়ে। যারা পুরান ঢাকার ইতিহাস ভালোবাসেন, যারা পুরনো দিনের কেক ও চানাচুরের স্বাদ ভুলতে পারেন না—তাদের জন্য এই দোকান এক স্বপ্নের নাম।
একদিন যদি পায়ে হেঁটে লক্ষ্মীবাজারে যান, একটু থেমে যান এই ছোট্ট দোকানটার সামনে। একটা কেক আর এক মুঠো চানাচুর নিন, চোখ বুজে এক কামড় দিন—আপনি ফিরে যাবেন সেই সময়, যখন স্বাদ ছিল অনুভব, আর বেকারি ছিল একটা চিরন্তন স্মৃতির ভাণ্ডার।