যুদ্ধের মধ্যেও গণতন্ত্রের লড়াই
ইউক্রেনের যুদ্ধজয়ের জন্য শুধু সাহস আর অস্ত্র নয়, দেশের জনগণ ও পশ্চিমা মিত্রদের আস্থাও অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সম্প্রতি একটি নতুন আইন সেই আস্থাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। ২২ জুলাই ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ‘রাডা’ একটি আইন পাস করেছে, যা দেশের দুটি প্রধান দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা—নাবু (NABU) ও সাপো (SAPO)—কে প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
এই সিদ্ধান্ত কোনো বিচ্ছিন্ন এমপিদের কাজ নয়, এটি ছিল প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তার প্রভাবশালী প্রধান সহযোগী (Chief of Staff) আন্দ্রি ইয়ারমাকের সরাসরি পরিকল্পনা। প্রেসিডেন্টের দল ‘সারভেন্ট অব দ্য পিপল’ থেকে ব্যাপক ভোটে আইনটি পাস হয়।
নতুন আইন কী বলছে?
এই নতুন আইন ইউক্রেনের অ্যাটর্নি জেনারেলকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিচ্ছে। তিনি প্রেসিডেন্টের অধীনস্থ এবং এখন থেকে দুর্নীতি তদন্তগুলোতে হস্তক্ষেপ, স্থানান্তর, এমনকি বন্ধ করারও ক্ষমতা পাবেন। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর কোনো মামলাই আর নিরাপদ থাকবে না।
সরকার দাবি করছে যে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোতে প্রো-রাশিয়ান অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাই এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ নেই এবং এটি বরং ২০১৪ সালের ‘রেভলিউশন অব ডিগনিটি’-এর পর গড়ে ওঠা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি স্পষ্ট চেষ্টা।
পশ্চিমা সমর্থন এখন ঝুঁকিতে
এই সংস্থাগুলো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি শক্তিশালী, আইননিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক ইউক্রেন গড়ে তোলা—যেটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সম্ভব হলে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথে অগ্রসর হবে। এই লক্ষ্যেই পশ্চিমারা যুদ্ধকালীন সহায়তা দিয়ে এসেছে।
কিন্তু তিন বছর অতিক্রান্ত যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের রূপরেখা স্পষ্ট নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে আমেরিকা যখন ইউক্রেনকে সহায়তা কমিয়েছে, তখন ইউরোপকে আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি ইউক্রেন আবার দুর্নীতিগ্রস্ত ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তবে ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণকে এই যুদ্ধকে ন্যায্য প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জয়ী হওয়া জরুরি নয়—তারা ইউক্রেনকে ভেতর থেকে ধ্বংস করেও জয় পেতে পারে। জর্জিয়ার দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলে, যে দেশ একসময় পশ্চিমের প্রিয়পাত্র ছিল, কিন্তু এখন রাশিয়ার অনুগত এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
জেলেনস্কির দায় ও পশ্চিমের নীরবতা
পশ্চিমা নেতারা জেলেনস্কিকে যুদ্ধের প্রথম দিকে নায়ক বানিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রশাসনের ব্যর্থতা, বিরোধীদের ওপর অব্যাহত চাপ এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীদের হয়রানির মতো বিষয়গুলো নিয়ে তারা পর্যাপ্ত প্রতিবাদ করেননি।
নতুন আইনটি কোনো বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নয়; এটি এসেছে এক দমনমূলক নীতির ধারাবাহিকতায়। সাবেক প্রেসিডেন্টসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ওপর “নিষেধাজ্ঞা” প্রয়োগ করা, সম্পদ জব্দ এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ তার প্রমাণ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো—রাডায় আইনটি পেশ ও পাস হওয়ার দিনই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সেটি অনুমোদন করেন। এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত কেবল আইনগতভাবে ভুল নয়, এটি কৌশলগত দিক থেকেও আত্মঘাতী। এটি ইউক্রেনকে এমন এক রাষ্ট্রের মতো করে তুলছে, যার সঙ্গে সে এখন যুদ্ধ করছে।
গণতন্ত্র বাঁচাতে আইনটি বাতিল জরুরি
এই আইন ইউক্রেনের ইউরোপীয় ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যখন পশ্চিমা সংহতি হ্রাস পাচ্ছে, তখন এমন একটি সিদ্ধান্ত সেই সংহতির নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে। যদি প্রেসিডেন্ট সত্যিই একটি গণতান্ত্রিক ইউক্রেন চান, তবে তাঁকে অবিলম্বে এই আইনটি বাতিল করতে হবে—তার আগেই যে আইনটি গণতন্ত্রের ধারণাকেই হত্যা করে দেবে।