অষ্টম পরিচ্ছেদ
আরও আধঘণ্টা চুবুককে পাহারা দিয়ে বসে রইলুম। কিন্তু একছুটে নিচে নেমে গিয়ে নদীতে একটা ডুব দিয়ে আসার ইচ্ছেটা এদিকে মনের মধ্যে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল। নিজেকেই বোঝালুম, ‘ধারেকাছে কেউ তো নেই। আর এত ভোরে, উঠছেই বা কে? তাছাড়া কাছাকাছি কোনো রাস্তাঘাটের চিহ্নমাত্র দেখছি না। আরে, ঘুমের মধ্যে চুবুক ওই পাশ ফেরার আগেই আমি স্নান সেরে ফিরে আসব।’
প্রলোভনটা অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠল। ইচ্ছের তাড়নায় আমার সারা শরীর হয়ে উঠল অস্থির। অদরকারী কার্তুজের রুশবেল্টা ছুড়ে ফেলে রেখে হঠাং একছুটে পাহাড় বেয়ে নেমে গেলুম।
যত কাছে মনে করেছিলুম, নদীটা মোটেই তত কাছে ছিল না। মনে হয়, নদীর ধারে পৌঁছতে আমার দশ মিনিট সময় লেগেছিল। বাড়ি থেকে পালানোর সময় ইশকুলের যে কালো টিউনিকটা পরে এসেছিলুম, সেটা ছেড়ে রাখলুম। তারপর একে একে চামড়ার ব্যাগ, বুটজোড়া আর ট্রাউজার্স খুলে রেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।
হঠাৎ ঠাণ্ডা জলে পড়ে যেন দম আটকে এল আমার। তারপর এদিক-ওদিক ঝাঁপাঝাপি শুরু করলুম, আর অল্পক্ষণের মধ্যেই শরীরটা গরম হয়ে গেল। উহ, কী আরামই যে বোধ করতে লাগলুম! নিঃশব্দে একবার মাঝনদী পর্যন্ত সাঁতরে গেলুম। মাঝনদীতে, ওই জায়গাটায়, একটা বালির চড়া আর সেই চড়ার ওপর একটা ঝোপ ছিল। ঝোপের গায়ে কী একটা যেন আটকে ছিল, হয় এক টুকরো ছোঁড়া ন্যাকড়া, নয় তো একটা কামিজ।
কাচা কাপড় কারো হাত থেকে হয়ত ফসকে গিয়েছিল। ঝেপের ডালপালা সরিয়ে জিনিসটা কী দেখতে গেলুম, কিন্তু দেখেই আঁতকে উঠে পিছিয়ে এলুম। একটা লোক উপুড় হয়ে শুয়ে ওখানে। তার ট্রাউজার্স’ বেধে ছিল একটা ডালে। পরনের সার্টটা গিয়েছিল ছি’ড়ে, আর তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, লোকটার পিঠে কালো-হয়ে-যাওয়া একটা মস্ত কাটা ঘা হাঁ হয়ে আছে। যেন ভূতে তাড়া করেছে এমনিভাবে তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে সাঁতার কেটে আমি পাড়ে ফিরে এলুম।
পড়ে উঠে জামা পরার সময় শিউরে উঠে মাঝনদীর সেই বালুচরের ওপর গজিয়ে-ওঠা ঝাঁপালো সবুজ ঝোপটার দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে নিলুম। নদীর জলেরই ধাক্কায় আপনা থেকে, নাকি আমি ঝোপের ডালপালাগুলো ফাঁক করায় দৈবক্রমে, সেই মরা মানুষের দেহটা ঝোপ থেকে ছাড়া পেয়েছিল তা ঠিক জানি না। কিন্তু এখন দেখলুম মড়াটা স্রোতের টানে উলটে গিয়ে জলে ভেসে আমি যে-পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম সেই দিকেই আসছে।