০৮:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৬) এআই দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার ভিডিও বানাচ্ছে কারা, শঙ্কা কোথায়? ২০২৫ সালে ৬০০-র বেশি বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নবগঙ্গা নদী: ইতিহাস, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও বর্তমান সংকট কঙ্কালসার হেমন্ত ‘ইন্ডিয়া আউট’ থেকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’, ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্কের সমীকরণ কি বদলাচ্ছে? গাজায় মানবিক সহায়তা সরবরাহে করিডোর খুলছে ইসরায়েল সহকারীর চাকরি হারিয়ে ছেলের সংগ্রাম, বাবার অসুস্থতা ও বাজারের আগুনে দগ্ধ এক পরিবার মোবাইল ও ইন্টারনেট বদলে দিচ্ছে টাকা লেনদেনের পদ্ধতি ভেপিং কি সত্যিই ফুসফুসের অপ্রতিকারযোগ্য রোগ সৃষ্টি করে? বিজ্ঞান যা বলছে, তা জানুন

‘ইন্ডিয়া আউট’ থেকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’, ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্কের সমীকরণ কি বদলাচ্ছে?

  • Sarakhon Report
  • ০৬:৫২:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
  • 11
‘মৌসুম’ যেমনই হোক, ‘অতীত’কে সরিয়ে রেখে আপাতত ‘দ্বিপাক্ষিক অংশীদ্বারিত্বের’ ওপরেই জোর দিতে চায় দিল্লি আর মালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহামেদ মুইজের বিবৃতিতে সেই প্রতিফলনই মিলেছে।

মি. মোদীর মালদ্বীপ সফরকালে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান গবেষণার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূচনা হয়েছে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাও।

যৌথ বিবৃতির সময় দুই দেশকে একে অপরের ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘গভীর সম্পর্কের’ কথা বলতে শোনা গেছে দুই রাষ্ট্রনেতাকেই।

মি. মোদী বলেছেন, “ভারত, মালদ্বীপের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের নেইবার ফার্স্ট নীতি এবং মহাসাগর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দুই বিষয়েই মালদ্বীপের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।”

“মালদ্বীপের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারত গর্ব বোধ করে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা মহামারী, ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের পাশে ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে থেকেছে।”

অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট মুইজ বলেছেন, “ভারত দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত অংশীদার। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা ও বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বাইরেও বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিস্তৃত, যা আমাদের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে।”

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিকে সামনে রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন মি. মুইজ। তার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন দেখা গিয়েছে যার আঁচ পরেছিল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও।

তবে মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো এবং দুই দেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে অংশীদারত্বের ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে–– ‘পরিস্থিতি বদলেছে’।

দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে
দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে নরেন্দ্রে মোদীর এই সফরে

যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে

প্রেসিডেন্ট মুইজ জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় দুই দেশই।

ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটে সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ এবং তিনটে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

মালদ্বীপকে ভারতীয় মূল্যে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকার লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) সম্প্রসারণ করার কথা ঘোষণা হয়েছে।

মি. মুইজ বলেছেন, “ওই এলওসি প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং হাউজিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবহার করা হবে। ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতও হয়েছে।”

পাশাপাশি, ভারত সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এলওসি-র ক্ষেত্রে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা হ্রাস করা হয়েছে।

ভারত-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আইএমএফটিএ) আলোচনার সূচনা হয়েছে। মালদ্বীপকে ৭২টা হেভি ভেহিকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে, মালেতে প্রতিরক্ষা ভবন এবং অবকাঠামোগত স্থাপনার উদ্বোধনও করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট মুইজই ক্ষমতায় আসার পরেই কিন্তু মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখেনি দিল্লি।

ভারত বিরোধী নীতির প্রচার করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুইজ
ভারতবিরোধী নীতির প্রচার করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুইজ

সম্পর্কের টানাপোড়েন

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ৬০ বছরের। এই সময়কালে বিভিন্ন সময় ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কে মোটের ওপর বন্ধুত্বপূর্ণই থেকেছে।

মি. মুইজ অন্য পথে হাঁটলেও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টরা ক্ষমতায় এসে প্রথম ভারত সফর করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতিই মেনে এসেছিলেন। একই মনোভাব দেখা গেছে অতীতেও।

নরেন্দ্র মোদীর সফর নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট সোলিহ বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফর এটাই দর্শায় যে রাজনৈতিক উসকানি সত্ত্বেও ভারতের মধ্যে এমন একজন বন্ধুকে মালদ্বীপ পেয়েছে যে বিশ্বস্ত এবং সময় তার প্রমাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

তবে ইব্রাহিম সোলিহর পূর্বসূরি আবদুল্লা ইয়ামিন ভারতের বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। সেই পথই অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল মি. মুইজকে।

প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছিল। ওই লেনদেন ২০২২ সালে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ায় এবং ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভারত মূলত মালদ্বীপে ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, সিমেন্ট, কৃষি পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রী রফতানি করে। মালদ্বীপ থেকে স্ক্র্যাপ ধাতু আমদানি করে ভারত।

তাছাড়া বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পর্যটক সে দেশে ভ্রমণে যান। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয় প্রেসিডেন্ট মুইজ ক্ষমতায় আসার পর।

মালদ্বীপের মন্ত্রীদের 'অবমাননাকর' পোস্টকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ‘অবমাননাকর’ পোস্টকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সুর কাটতে শুরু করেছিল তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই। ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির প্রচার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোহামেদ মুইজ।

তারপর গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়াম শিউনা এবং অন্যান্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।

ভারতে ট্রেন্ড করতে থাকে ‘বয়কট মালদ্বীপ’–– যার জেরে ভারত থেকে সে দেশে আগত পর্যটকের ঢলেও প্রভাব পড়ে।

ক্ষমতায় আসার আগেই মালদ্বীপ থেকে ‘বিদেশি সেনা’ সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মি. মুইজ।

প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় আসার পর চীন সফরে যান এবং তারপর ফিরে এসেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বার্তা দেন দিল্লিকে। এরজন্য সময়ও বেঁধে দেন।

প্রকারান্তরে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, ভারত ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।

অন্যদিকে, ভারত বরাবরই দাবি করেছে মানবিক সহায়তা ও জনকল্যামূলক সহযোগিতার জন্যই সেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। একে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়।

এদিকে পর্যটকদের একটা বড় অংশ মালদ্বীপের পরিবর্তে অন্য জায়গাকে পর্যটনের জন্য বেছে নেন।

তবে সমীকরণে পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। গত বছর প্রেসিডেন্ট মুইজ ভারত সফরে আসেন। সেই সময় ভারতের তরফেও সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সময় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন সম্পর্কের বরফ গলছে।

অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিশেষত দেশের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ার ফলে মুইজ সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়ার বিষয়গুলো রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

একইসঙ্গে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দেশকে ভারতেরও প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

‘মৌসুম যেমনই হোক, বন্ধুত্ব থাকবে’

ভারত-মালদ্বীপের অংশীদারিত্বের ওপর জোর দিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতাই।

মি. মোদী বলেছেন, “মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার উন্নয়নে ভারত সমর্থন অব্যাহত রাখবে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি লাভ আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য। কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের মাধ্যমে আমরা একসঙ্গে আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলব।”

“প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা পারস্পরিক আস্থার প্রতিফলন।”

পাশাপাশি ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিস্থিতি যাই হোক, সম্পর্ক অটুট থাকবে। তার কথায়,”আবহাওয়া বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমাদের সহযোগিতা প্রসারিত হবে। আবহাওয়া যাই হোক না কেন, আমাদের বন্ধুত্ব সবসময় উজ্জ্বল এবং পরিষ্কার থাকবে!”

একই সুর শোনা গিয়েছে মি. মুইজের কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, “মালদ্বীপ সরকার একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে, তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে ভারত সহায়কের ভূমিকা পালন করে।”

ভারত-মালদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিটের উদ্বোধন।
ভারত-মালদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিটের উদ্বোধন

বিশেষজ্ঞরা যেভাবে দেখছেন

“রাজনীতিতে কিছুই স্থায়ী হয় না। কেউ স্থায়ী মিত্র হয় না, আবার স্থায়ী শত্রুও হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য,” ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কের সাম্প্রতিকতম সমীকরণকে এইভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমার আঘা।

তিনি বলেছেন, “দুই দেশের সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে গিয়েও দুই দেশের সম্পর্কের ভিত লুকিয়ে আছে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে।”

“রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বিপর্যয় মোকাবিলা-সমস্ত ক্ষেত্রেই মালদ্বীপের পাশে থেকেছে ভারত। কিন্তু সম্পর্কে পরিবর্তনের একটা বড় কারণ চীন। তাদের প্রাধান্য দিতে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে মালদ্বীপ।”

তার মতে, নিজের দেশেই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে মুইজ সরকারকে।

“স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান নিয়ে দেশের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মেছে। চীনের কাছ থেকে তেমন সুরাহা পায়নি। তাই ভারতকে তাদের প্রয়োজন।”

“একইভাবে ভারতেরও কিন্তু এই প্রতিবেশী দেশকে দরকার। তার কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক।”

মানব রচনা ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজ-এর অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এক্সপার্ট উপমন্যু বসুর মতে সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে ভারতেরও কারণ রয়েছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “ভারত নেইবার ফার্স্ট নীতির কথা বলে আসলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল সবার ক্ষেত্রেই ভারতের বিদেশ নীতির সমালোচনা হয়েছে।”

“দিল্লি কিন্তু এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়েছে তাই মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেছে। পাশাপাশি মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তো রয়েছেই।”

গত বছর আক্টোবরে ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ।
গত বছর আক্টোবরে ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ।

চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কের বিষয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন এই বিশেষজ্ঞ।

তার কথায়, “চীন কিন্তু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে টানাপোড়েনের মধ্যে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলায় আগ্রহী। চীন মালদ্বীপে নিবেশও করেছিল, কিন্তু তাতে মালদ্বীপের তেমন সুবিধা হয়নি।”

“তারা (মালদ্বীপ) কিন্তু বৈচিত্রমূলক অর্থনীতির বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে, তাদের ভারতকেও প্রয়োজন। যে স্থিতিশীলতা তাদের দরকার সেটা ভারত দিতে পারবে, চীন না।”

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরেই মালদ্বীপের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা শুরুর বিষয়টাও উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে কূটনৈতিক জয় বলে মনে করা হয়। সদ্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। এখন এমন একটা দেশের সঙ্গে তারা এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে যার সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে সম্পর্ক তেমন মধুর ছিল না। এটা আন্তর্জাতিক স্তরে একটা বার্তা দেয়।”

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন দিকে যায় তা নজরে রাখার বিষয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ।

মি. আঘা বলেছেন, “দুই দেশে সহযোগিতা এবং অংশীদারত্বে আগ্রহী এটা ইতিবাচক বিষয়। ভবিষ্যতে বিষয়টা কোন দিকে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।”

অন্যদিকে, চীন বিষয়টাকে কীভাবে নেবে তাও দেখার বলে মনে করেন মি. বসু।

তার কথায়, “ভারত-মালদ্বীপের এই সম্পর্কের উপরে চীনেরও নজর রয়েছে। তারা আরও আগ্রাসী পদক্ষেপ নেই কি না সেদিকেও নজর রাখতে হবে।”

বিবিসি নিউজ বাংলা

রণক্ষেত্রে (পর্ব-৮৬)

‘ইন্ডিয়া আউট’ থেকে ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’, ভারত-মালদ্বীপের সম্পর্কের সমীকরণ কি বদলাচ্ছে?

০৬:৫২:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
‘মৌসুম’ যেমনই হোক, ‘অতীত’কে সরিয়ে রেখে আপাতত ‘দ্বিপাক্ষিক অংশীদ্বারিত্বের’ ওপরেই জোর দিতে চায় দিল্লি আর মালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহামেদ মুইজের বিবৃতিতে সেই প্রতিফলনই মিলেছে।

মি. মোদীর মালদ্বীপ সফরকালে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান গবেষণার মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সূচনা হয়েছে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাও।

যৌথ বিবৃতির সময় দুই দেশকে একে অপরের ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘গভীর সম্পর্কের’ কথা বলতে শোনা গেছে দুই রাষ্ট্রনেতাকেই।

মি. মোদী বলেছেন, “ভারত, মালদ্বীপের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের নেইবার ফার্স্ট নীতি এবং মহাসাগর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দুই বিষয়েই মালদ্বীপের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।”

“মালদ্বীপের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারত গর্ব বোধ করে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় হোক বা মহামারী, ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের পাশে ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে থেকেছে।”

অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট মুইজ বলেছেন, “ভারত দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত অংশীদার। আমাদের সহযোগিতা নিরাপত্তা ও বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং বাইরেও বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিস্তৃত, যা আমাদের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করে।”

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতিকে সামনে রেখে ক্ষমতায় এসেছিলেন মি. মুইজ। তার শাসনকালে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কে বেশ টানাপোড়েন দেখা গিয়েছে যার আঁচ পরেছিল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও।

তবে মালদ্বীপের ৬০তম স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো এবং দুই দেশের মধ্যে একাধিক বিষয়ে অংশীদারত্বের ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে–– ‘পরিস্থিতি বদলেছে’।

দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে
দুই দেশের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে নরেন্দ্রে মোদীর এই সফরে

যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে

প্রেসিডেন্ট মুইজ জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় দুই দেশই।

ভারত এবং মালদ্বীপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চারটে সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ এবং তিনটে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

মালদ্বীপকে ভারতীয় মূল্যে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকার লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) সম্প্রসারণ করার কথা ঘোষণা হয়েছে।

মি. মুইজ বলেছেন, “ওই এলওসি প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং হাউজিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবহার করা হবে। ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতও হয়েছে।”

পাশাপাশি, ভারত সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এলওসি-র ক্ষেত্রে বার্ষিক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা হ্রাস করা হয়েছে।

ভারত-মালদ্বীপ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আইএমএফটিএ) আলোচনার সূচনা হয়েছে। মালদ্বীপকে ৭২টা হেভি ভেহিকেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে, মালেতে প্রতিরক্ষা ভবন এবং অবকাঠামোগত স্থাপনার উদ্বোধনও করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট মুইজই ক্ষমতায় আসার পরেই কিন্তু মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখেনি দিল্লি।

ভারত বিরোধী নীতির প্রচার করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুইজ
ভারতবিরোধী নীতির প্রচার করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুইজ

সম্পর্কের টানাপোড়েন

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘ ৬০ বছরের। এই সময়কালে বিভিন্ন সময় ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কে মোটের ওপর বন্ধুত্বপূর্ণই থেকেছে।

মি. মুইজ অন্য পথে হাঁটলেও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টরা ক্ষমতায় এসে প্রথম ভারত সফর করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহ ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতিই মেনে এসেছিলেন। একই মনোভাব দেখা গেছে অতীতেও।

নরেন্দ্র মোদীর সফর নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট সোলিহ বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদীর সফর এটাই দর্শায় যে রাজনৈতিক উসকানি সত্ত্বেও ভারতের মধ্যে এমন একজন বন্ধুকে মালদ্বীপ পেয়েছে যে বিশ্বস্ত এবং সময় তার প্রমাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুই দেশের সম্পর্কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

তবে ইব্রাহিম সোলিহর পূর্বসূরি আবদুল্লা ইয়ামিন ভারতের বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। সেই পথই অনুসরণ করতে দেখা গিয়েছিল মি. মুইজকে।

প্রসঙ্গত, ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছিল। ওই লেনদেন ২০২২ সালে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ায় এবং ২০২৩ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভারত মূলত মালদ্বীপে ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, সিমেন্ট, কৃষি পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রী রফতানি করে। মালদ্বীপ থেকে স্ক্র্যাপ ধাতু আমদানি করে ভারত।

তাছাড়া বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পর্যটক সে দেশে ভ্রমণে যান। কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয় প্রেসিডেন্ট মুইজ ক্ষমতায় আসার পর।

মালদ্বীপের মন্ত্রীদের 'অবমাননাকর' পোস্টকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
মালদ্বীপের মন্ত্রীদের ‘অবমাননাকর’ পোস্টকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল

দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সুর কাটতে শুরু করেছিল তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই। ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতির প্রচার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোহামেদ মুইজ।

তারপর গত বছর জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরের ছবিতে মালদ্বীপের মন্ত্রী মরিয়াম শিউনা এবং অন্যান্য নেতাদের আপত্তিজনক মন্তব্যকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক।

ভারতে ট্রেন্ড করতে থাকে ‘বয়কট মালদ্বীপ’–– যার জেরে ভারত থেকে সে দেশে আগত পর্যটকের ঢলেও প্রভাব পড়ে।

ক্ষমতায় আসার আগেই মালদ্বীপ থেকে ‘বিদেশি সেনা’ সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মি. মুইজ।

প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় আসার পর চীন সফরে যান এবং তারপর ফিরে এসেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বার্তা দেন দিল্লিকে। এরজন্য সময়ও বেঁধে দেন।

প্রকারান্তরে তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, ভারত ‘হস্তক্ষেপ’ করছে।

অন্যদিকে, ভারত বরাবরই দাবি করেছে মানবিক সহায়তা ও জনকল্যামূলক সহযোগিতার জন্যই সেখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। একে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়।

এদিকে পর্যটকদের একটা বড় অংশ মালদ্বীপের পরিবর্তে অন্য জায়গাকে পর্যটনের জন্য বেছে নেন।

তবে সমীকরণে পরিবর্তন দেখা যেতে শুরু করে। গত বছর প্রেসিডেন্ট মুইজ ভারত সফরে আসেন। সেই সময় ভারতের তরফেও সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সময় বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অনুমান করেছিলেন সম্পর্কের বরফ গলছে।

অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, বিশেষত দেশের আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ার ফলে মুইজ সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়ার বিষয়গুলো রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

একইসঙ্গে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দেশকে ভারতেরও প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

‘মৌসুম যেমনই হোক, বন্ধুত্ব থাকবে’

ভারত-মালদ্বীপের অংশীদারিত্বের ওপর জোর দিয়েছেন দুই রাষ্ট্রনেতাই।

মি. মোদী বলেছেন, “মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার উন্নয়নে ভারত সমর্থন অব্যাহত রাখবে। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি লাভ আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য। কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের মাধ্যমে আমরা একসঙ্গে আঞ্চলিক সামুদ্রিক নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলব।”

“প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা পারস্পরিক আস্থার প্রতিফলন।”

পাশাপাশি ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিস্থিতি যাই হোক, সম্পর্ক অটুট থাকবে। তার কথায়,”আবহাওয়া বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমাদের সহযোগিতা প্রসারিত হবে। আবহাওয়া যাই হোক না কেন, আমাদের বন্ধুত্ব সবসময় উজ্জ্বল এবং পরিষ্কার থাকবে!”

একই সুর শোনা গিয়েছে মি. মুইজের কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, “মালদ্বীপ সরকার একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে, তরুণদের ক্ষমতায়ন এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে ভারত সহায়কের ভূমিকা পালন করে।”

ভারত-মালদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিটের উদ্বোধন।
ভারত-মালদ্বীপের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিটের উদ্বোধন

বিশেষজ্ঞরা যেভাবে দেখছেন

“রাজনীতিতে কিছুই স্থায়ী হয় না। কেউ স্থায়ী মিত্র হয় না, আবার স্থায়ী শত্রুও হয় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য,” ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্কের সাম্প্রতিকতম সমীকরণকে এইভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমার আঘা।

তিনি বলেছেন, “দুই দেশের সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরে গিয়েও দুই দেশের সম্পর্কের ভিত লুকিয়ে আছে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে।”

“রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে বিপর্যয় মোকাবিলা-সমস্ত ক্ষেত্রেই মালদ্বীপের পাশে থেকেছে ভারত। কিন্তু সম্পর্কে পরিবর্তনের একটা বড় কারণ চীন। তাদের প্রাধান্য দিতে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে মালদ্বীপ।”

তার মতে, নিজের দেশেই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে মুইজ সরকারকে।

“স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান নিয়ে দেশের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জন্মেছে। চীনের কাছ থেকে তেমন সুরাহা পায়নি। তাই ভারতকে তাদের প্রয়োজন।”

“একইভাবে ভারতেরও কিন্তু এই প্রতিবেশী দেশকে দরকার। তার কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক।”

মানব রচনা ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজ-এর অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স এক্সপার্ট উপমন্যু বসুর মতে সম্পর্ক উন্নয়নের পেছনে ভারতেরও কারণ রয়েছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “ভারত নেইবার ফার্স্ট নীতির কথা বলে আসলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপাল সবার ক্ষেত্রেই ভারতের বিদেশ নীতির সমালোচনা হয়েছে।”

“দিল্লি কিন্তু এই বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়েছে তাই মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেছে। পাশাপাশি মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তো রয়েছেই।”

গত বছর আক্টোবরে ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ।
গত বছর আক্টোবরে ভারত সফরে প্রেসিডেন্ট মুইজ।

চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কের বিষয়ে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন এই বিশেষজ্ঞ।

তার কথায়, “চীন কিন্তু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে টানাপোড়েনের মধ্যে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলায় আগ্রহী। চীন মালদ্বীপে নিবেশও করেছিল, কিন্তু তাতে মালদ্বীপের তেমন সুবিধা হয়নি।”

“তারা (মালদ্বীপ) কিন্তু বৈচিত্রমূলক অর্থনীতির বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে, তাদের ভারতকেও প্রয়োজন। যে স্থিতিশীলতা তাদের দরকার সেটা ভারত দিতে পারবে, চীন না।”

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পরেই মালদ্বীপের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা শুরুর বিষয়টাও উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে কূটনৈতিক জয় বলে মনে করা হয়। সদ্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। এখন এমন একটা দেশের সঙ্গে তারা এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে যার সঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে সম্পর্ক তেমন মধুর ছিল না। এটা আন্তর্জাতিক স্তরে একটা বার্তা দেয়।”

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন দিকে যায় তা নজরে রাখার বিষয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ।

মি. আঘা বলেছেন, “দুই দেশে সহযোগিতা এবং অংশীদারত্বে আগ্রহী এটা ইতিবাচক বিষয়। ভবিষ্যতে বিষয়টা কোন দিকে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।”

অন্যদিকে, চীন বিষয়টাকে কীভাবে নেবে তাও দেখার বলে মনে করেন মি. বসু।

তার কথায়, “ভারত-মালদ্বীপের এই সম্পর্কের উপরে চীনেরও নজর রয়েছে। তারা আরও আগ্রাসী পদক্ষেপ নেই কি না সেদিকেও নজর রাখতে হবে।”

বিবিসি নিউজ বাংলা