হারানো চাকরি, ভেঙে পড়া সংসার
মাত্র ২২ বছর বয়স হৃদয়ের। রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুই বছর ধরে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ছোট চাকরি, কিন্তু মাস শেষে নির্দিষ্ট একটি বেতন পেতেন—মাত্র ১০ হাজার টাকা। এই সামান্য আয়ে চলতো তার তিন সদস্যের পরিবার: অসুস্থ বাবা, মায়ের সংসার আর হৃদয়ের স্বপ্ন।
কিন্তু কয়েক মাস আগে একটি ডেলিভারির কাগজ ভুল স্থানে জমা দেওয়ার ঘটনায় অফিস থেকে চাকরিচ্যুত হন তিনি। প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে—এই অভিযোগে কোনো আলোচনা ছাড়াই তাকে বের করে দেওয়া হয়। যদিও হৃদয়ের দাবি, ভুলটা অনিচ্ছাকৃত ছিল। অফিসে নতুন সফটওয়্যার ব্যবহারে কেউই তখন অভ্যস্ত ছিলেন না।
চাকরি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন হৃদয়ের জীবনের সব আলো নিভে যায়। এখন তিনি বেকার। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ খুঁজে বেড়ান।
অসুস্থ বাবার ওষুধের হিসাব আর বাজারের হাহাকার
হৃদয়ের বাবা আহসান উদ্দিন প্রায় এক বছর ধরে অসুস্থ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর কিডনির সমস্যা পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ওষুধ লাগে। সপ্তাহে অন্তত একবার চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে হয়। প্রতিবার চেম্বার ফি ৫০০ টাকা। ওষুধে খরচ গড়ে মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা।
এদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন মধ্যবিত্ত তো দূরের কথা, নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরেই চলে গেছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ডিম—সব কিছুর দাম যেন আগুন। এক কেজি মসুর ডাল ১৩০ টাকা, সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা লিটার, পেঁয়াজ ৯০ টাকা কেজি।
হৃদয় বলেন, “বাবার জন্য প্রতিদিন দুধ কিনতে হয়, ওষুধ তো আছেই। এখন বাজারে গেলে আগে তালিকা করি, পরে দাম দেখে অর্ধেক বাদ দিতে হয়।”
প্রতিদিনের সংগ্রাম, সামনের দিন অন্ধকার
হৃদয় এখন মাঝে মাঝে দিনমজুরের কাজ করেন। ভবনের নির্মাণ কাজে সহায়তা, কোনো অফিসে সাময়িকভাবে কিছু কাগজপত্র সরানো—যা পান, তাই করেন। কিন্তু আয় অনিয়মিত। কখনো ৩৫০ টাকা, কখনো সারা দিন খুঁজেও কোনো কাজ মেলে না।
তিনি বলেন, “আমার জীবনটা থমকে গেছে। আগে অন্তত জানতাম মাস শেষে কিছু আসবে। এখন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো দিন বাবার ওষুধ কিনে খাওয়া হয় না, কোনো দিন খেয়ে বাবার ওষুধ বাদ দিতে হয়।”
সাহায্য নেই, সমাজ নেই, শুধু একলা লড়াই
স্থানীয় কাউন্সিলর বা কোনো এনজিওর কাছ থেকেও কোনো সহযোগিতা পাননি হৃদয়। সাহায্যের জন্য কয়েকবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোথাও সাড়া মেলেনি। সরকারি কোনো ভাতার আওতায়ও পড়েন না তারা।
হৃদয় বলেন, “ভাতার কার্ড করতে গেলে বলে ভোটার আইডি ঠিক নেই। আবার কোথাও গেলে বলে, আমার বয়স কম। কেউ জিজ্ঞেসও করে না—এই বয়সে আমি পরিবার চালাচ্ছি কিনা।”
ভবিষ্যতের স্বপ্ন, নাকি কেবল টিকে থাকার লড়াই?
হৃদয় একসময় পড়ালেখা করতেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেও আর এগোতে পারেননি। ইচ্ছে ছিল, একদিন নিজের ছোট একটা দোকান দেবেন। এখন সে স্বপ্ন ধূসর। এখন একমাত্র লক্ষ্য—পরিবারটা যেন অনাহারে না থাকে, বাবার ওষুধ যেন বন্ধ না হয়।
তার কণ্ঠে বিষাদের সুর, “সবাই বলে নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে হবে। আমি তো চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রতিদিন নতুন করে হারছি। জানি না এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়।”
এই শহরের অলিগলিতে হৃদয়ের মতো অসংখ্য তরুণ রয়েছেন—যারা ভুলে, দুর্ভাগ্যে কিংবা সিস্টেমের বাইরে পড়ে জীবনের সঙ্গে কঠিন লড়াই করছেন। হৃদয় শুধু একজন নয়, সে এক প্রতীক—এই সময়ের অসহায় তরুণের, অসুস্থ বাবার ছেলের, একটুখানি আয়ের আশায় প্রতিদিন রাস্তায় বেরিয়ে পড়া একটি মুখের।