অস্তিত্বের লড়াই, নাকি সুবিধাভোগের রাজনীতি?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। এদের অনেকেরই জনভিত্তি নেই, নেই নতুন কোনো রাজনৈতিক দর্শন কিংবা জনজীবনের পরিবর্তনের কার্যকর পরিকল্পনা। তবুও দলগুলো টিকে আছে—কখনো জোটে, কখনো বিবৃতিতে, আবার কখনো নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। প্রশ্ন উঠছে—জনসমর্থনহীন, ধোঁয়াশাপূর্ণ কর্মসূচি ও বারবার ব্যর্থ আন্দোলনের পরও তারা কেন রাজনীতি করে? বিশেষ করে একটি অনির্বাচিত বা অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তখন তাদের কণ্ঠ সবচেয়ে উচ্চস্বরে কেন শোনা যায়?
জনভিত্তি না থাকলেও রাজনৈতিক ব্যস্ততা
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪০টির বেশি হলেও, বাস্তবে মাঠে সক্রিয় দল ৫-৬টি মাত্র। বাকি ছোট দলগুলো কেবল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, প্রেস কনফারেন্স আর টকশোতেই সীমাবদ্ধ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব দলের অনেকটাই নামেমাত্র দল, যাদের অনেকেই নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ক্ষমতার ছায়ায় কিছু সুবিধা নেওয়ার জন্য রাজনীতি করে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহমুদ হাসান বলেন,
“এই ছোট দলগুলো জনগণের প্রয়োজন মেটাতে রাজনীতি করছে না। বরং রাজনীতিকে ব্যবহার করছে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে। অনেকেই আবার কোনো বড় দলের ছায়ায় থেকে সুযোগের রাজনীতি করে।”
অরাজনৈতিক বা অনির্বাচিত সরকার এলেই সক্রিয়তা কেন বাড়ে?
বাংলাদেশে যখনই একটি অনির্বাচিত বা তত্ত্বাবধায়ক-সদৃশ অরাজনৈতিক সরকার আসে, তখনই এসব ছোট দলের দাবি-দাওয়া, বিবৃতি, মঞ্চ ও সংলাপের আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ বেড়ে যায়। কারণ তখন মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো অনিশ্চয়তায় থাকে এবং শাসনক্ষমতা বিভাজনের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
রাজনৈতিক সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম বলেন,
“অসাংবিধানিক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন আসে, তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি বা রাজনৈতিক বোর্ড গঠনের সুযোগ থাকে। তখনই এসব ছোট দল নিজেদের সরব করতে শুরু করে, যাতে অন্তত নামটা আলোচনায় থাকে। অনেকে উপদেষ্টা বা কমিশনের পদের আশায় সক্রিয় হয়।”
জনগণের চোখে এসব দলের অবস্থান
ঢাকার এক অটোরিকশাচালক মতিউর রহমান বলেন,
“নামই শুনিনি এমন দলের নেতাকে দেখি প্রেসক্লাবে বক্তৃতা দিচ্ছে। এরা কার জন্য রাজনীতি করে, কিছুই বুঝি না। ভোটেও তো দেখি না।”
একজন কলেজছাত্রী ফারিহা সুলতানা বলেন,
“ছোট দলগুলো কখনো জনগণের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না। বরং যখনই রাজনৈতিক সংকট আসে, তখনই তারা জেগে ওঠে। এটা দেখে মনে হয়, যেন এসব দল আসলে জনগণের জন্য নয়, বরং কোনো ‘মওকার’ জন্য অপেক্ষা করে।”
ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার প্রতিযোগিতা
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ছোট দলগুলোর বড় অংশই মূলত রাজনৈতিক ঠিকাদারি বা সুবিধাভোগী রাজনীতির অংশ। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেই কমিশন, কনসালট্যান্সি, বিদেশ সফর, এনজিও তহবিল কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা সুবিধায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। তাই অরাজনৈতিক সরকার এলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে—আশায় থাকে ভবিষ্যতের কোনো সমন্বয় কমিটিতে ঠাঁই পেতে পারে।
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া ভবিষ্যৎ নেই
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফারহানা তানজীম বলেন,
“সংবিধান অনুযায়ী বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও বাস্তবে অনেক দলই গণতন্ত্রের নামে সুবিধাবাদী রাজনীতি করে। যদি রাজনৈতিক সংস্কার না হয়, যদি দলের নিবন্ধনের মানে কেবল একটি কাগজে নাম লেখা হয়, তাহলে গণতন্ত্র নয়—বরং বিভ্রান্তি তৈরি হয়।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছোট দলগুলোর অবদান প্রায় নেই বললেই চলে। তারা মাঠে নেই, জনগণের সঙ্গে নেই, নেই ত্যাগ কিংবা আন্দোলনের ঐতিহ্য। তবুও যখনই শাসনব্যবস্থায় ফাঁক তৈরি হয়, তখনই তারা আলোচনায় আসার চেষ্টা করে। এই প্রবণতা শুধু রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে না, জনআস্থাও হ্রাস করে। তাই সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—রাজনীতি কি কেবল পত্রিকায় নাম তোলার খেলা, নাকি জনগণের জন্য দায়িত্ববোধের বাস্তব অনুশীলন?