মোবাইল ও ইন্টারনেটের শক্তিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নতুন দিগন্ত
বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ব্যাংক-সংযুক্ত ওয়ালেট—সবই এখন সহজে ও কম খরচে সাধারণ মানুষের নাগালে। ডিজিটাল সেবাগুলো শুধু সুবিধাজনক নয়, এটি অর্থ ব্যবস্থাপনায় মানুষের সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে।
দৈনন্দিন সঞ্চয় থেকে বিদ্যুৎ বিল—সব কিছুই এখন ডিজিটালে
ডিজিটাল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে এখন মানুষ স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে দৈনন্দিন সঞ্চয় জমা দিতে পারে, অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ নিতে ও পরিশোধ করতে পারে এবং এমনকি মোবাইলেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কিনতেও পারে। এর ফলে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী আর্থিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব।
গ্লোবাল ফিনডেক্স ২০২৫-এর চিত্র: হিসাবের মালিকানা বেড়েছে
বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্কদের ৭৯ শতাংশের এখন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০১১ সালে এই হার ছিল মাত্র ৫১ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৭৪ শতাংশ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এই হার এখন ৭৫ শতাংশ, যা অভূতপূর্ব অগ্রগতি নির্দেশ করে।
প্রযুক্তির প্রভাবে অ্যাকাউন্ট ব্যবহারে বৃদ্ধি
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গত দশকে এই অ্যাকাউন্টই মূলত আর্থিক অন্তর্ভুক্তির চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। এসব অঞ্চলে এখন অর্ধেকের বেশি অ্যাকাউন্ট ডিজিটালি সক্রিয়—মোবাইল ফোন বা কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন সম্ভব।
সাব-সাহারান আফ্রিকা এই খাতে অগ্রগামী—২০২৪ সালে সেখানে ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যা ২০২১ সালের ২৭ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলেও এই হার ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির ফলে সঞ্চয় ও লেনদেনে গতি
ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের কারণে আনুষ্ঠানিক সঞ্চয়ের হারও বেড়েছে। ২০২৪ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৪০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক সঞ্চয়ের জন্য অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছেন, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৬ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।
বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা ও সাব-সাহারান আফ্রিকায় মোবাইল মানির মাধ্যমে সঞ্চয়ের হার যথাক্রমে ১৯ ও ২৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১০ শতাংশ পয়েন্টেরও বেশি বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবহারে দ্রুত অগ্রগতি
এই দেশগুলোতে এখন ৬১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বা অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষ অন্তত একবার ডিজিটাল পেমেন্ট করেছেন বা গ্রহণ করেছেন। ২০১৪ সালের তুলনায় এটি ২৭ শতাংশ পয়েন্টের বৃদ্ধি। ২০২৪ সালে ডিজিটাল মার্চেন্ট পেমেন্ট—অর্থাৎ দোকান বা অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ডিজিটাল লেনদেন—৪২ শতাংশে পৌঁছেছে।
ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা শুধু ক্রেতাদের জন্য নয়, বিক্রেতাদের জন্যও। নগদ লেনদেনের তুলনায় এটি নিরাপদ এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ পাওয়ার পথ সহজ করে দেয়, কারণ এটি নগদ প্রবাহের স্বচ্ছ রেকর্ড তৈরি করে।
চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে: অন্তর্ভুক্তির পথ সহজ নয়
অগ্রগতির পরও দুটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে:
১. এখনো বিশ্বের ১৩০ কোটির (১.৩ বিলিয়ন) বেশি প্রাপ্তবয়স্কের কোনো ব্যাংক বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্ট নেই। অথচ তাদের কাছে মোবাইল ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও সিম কার্ড রয়েছে—যা ডিজিটাল অর্থ ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ভিত্তি। যদি তাদের জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক আর্থিক পণ্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তারাও অন্তর্ভুক্তির আওতায় আসতে পারেন।
২. যাদের অ্যাকাউন্ট আছে কিন্তু কার্যকরভাবে ব্যবহার করেন না, তাদের জন্য প্রয়োজন ভিন্নধর্মী পরিকল্পনা। আন্তঃসংযোগ সুবিধাযুক্ত দ্রুত পেমেন্ট ব্যবস্থা ও কার্যকর গ্রাহক সুরক্ষা নীতিমালা থাকলে তাদের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় যুক্ত করা সম্ভব হবে।
অন্তর্ভুক্তির ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চাই অবকাঠামো ও আস্থা
ডিজিটাল প্রযুক্তি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহজ করেছে, তবে ভবিষ্যতে এই অন্তর্ভুক্তিকে বিস্তৃত করতে হলে প্রয়োজন সঠিক অবকাঠামো, দ্রুত পেমেন্ট ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী গ্রাহক সুরক্ষা ব্যবস্থা।
এই অগ্রগতির সুফল পেতে হলে, অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবাদাতাদেরও প্রয়োজন মানুষের সক্ষমতা, আস্থা ও প্রয়োজন বিবেচনায় নীতিমালা প্রণয়ন করা। ভবিষ্যতের লক্ষ্য হওয়া উচিত—সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও টেকসই ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা নিশ্চিত করা।