ভূমিকা: এক নদীর গল্প, এক অঞ্চলের প্রাণ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছায়াঘেরা কৃষিভূমি, বনানী ও খনিজ মাটির মাঝখানে বয়ে চলা একটি নদীর নাম নবগঙ্গা। নদীটি শুধু একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, এটি ছিল খুলনা, যশোর, নড়াইল ও মাগুরা জেলার লাখো মানুষের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও পরিবেশের কেন্দ্রবিন্দু। একসময় এই নদীর প্রবাহ ছিল প্রাণবন্ত, তীরে ছিল জীবনের স্পন্দন, জলে ছিল মাছের ছলাৎছল, আর কুলে ছিল মানুষের গান, উৎসব ও স্মৃতি। কিন্তু আজ সেই নবগঙ্গা নদী হারিয়ে যাচ্ছে—খরা মৌসুমে সে হয়ে ওঠে নিষ্প্রাণ, বর্ষায়ও তার স্রোত যেন হাহাকার।
নবগঙ্গার ভৌগোলিক সংযোগ: নদীপথের সেতুবন্ধন
নবগঙ্গা নদীর উৎপত্তি মাগুরার নবগঙ্গা সড়কের অদূরে, একটি প্রাকৃতিক উৎস থেকে। ইতিহাসে জানা যায়, একসময় এই নদী সরাসরি গড়াই ও মধুমতী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। নদীটি প্রবাহিত হয়ে মাগুরা, নড়াইল ও যশোর জেলা অতিক্রম করে চিত্রা ও ভৈরব নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে খুলনার দিক দিয়ে দক্ষিণে চলে যেত। এই পথটি কেবল একটি নদীপথ ছিল না, ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণরেখা। নবগঙ্গার মাধ্যমে যশোরের চাষের পণ্য, মসলিন, কাঠ ও কাপড় খুলনায় আসত এবং সেখান থেকে নৌযানে কলকাতা পর্যন্ত যেত। সেই সময়কার নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় নবগঙ্গা ছিল একটি অপরিহার্য অংশ।
দুই শতাব্দী আগের নবগঙ্গার পাড়ে জীবন
প্রায় দুই শতাব্দী আগে নবগঙ্গা ছিল প্রবল প্রবাহমান, প্রশস্ত ও গভীর নদী। নদীর দুই তীর ঘিরে ছিল ঘন নারকেল, খেজুর, তাল ও সুপারি গাছের সারি। বর্ষায় পানির ধারে ফুটে উঠত হিজল, করচ, গর্জন, শিমুল ও অশ্বত্থ গাছের ছায়াবৃক্ষ। বসন্তকালে ফুলে ফুলে নদীপাড় হয়ে উঠত বর্ণিল, যেন প্রকৃতির আঁকা এক ক্যানভাস। নদীপাড়ে বিস্তীর্ণ বাগানে ফলত পেঁপে, কলা, আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা ও জাম।
ছোট ছোট হাট ও বাজার গড়ে উঠেছিল নদীর আশেপাশে। হাটের দিনে জেলেরা তাজা মাছ নিয়ে আসতেন বিক্রির জন্য—বোয়াল, আইড়, পাবদা, শোল, টেংরা, চিতল, কাতলা, রুই—এসব ছিল প্রতিদিনকার দৃশ্য। সেই সময় নবগঙ্গার পাড় ছিল শুধু অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের স্থান নয়, ছিল মানুষের মেলবন্ধনের কেন্দ্র।
নবগঙ্গা ও জীববৈচিত্র্যের স্বর্ণযুগ
নদীটির আশেপাশে একসময়ে ছিল বিস্তীর্ণ বন্যপ্রাণের আবাসভূমি। শেয়াল, বেজি, খরগোশ, বনমোরগসহ নানা প্রজাতির প্রাণী এই নদীর ধারে বাস করত। নদীর ধারে দেখা যেত ব্যাঙ, কাঁকড়া ও কচ্ছপের আনাগোনা। শীত এলেই হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এসে ভিড় করত নদীর বাঁকে বাঁকে। বন্যহাঁস ও পানকৌড়ির দল নদীর জলে সাঁতার কাটত, ছিল একটি চিরচেনা চিত্র। শিশুরা নদীর ধারে খেলা করত, পাখিদের অনুসরণ করত, আর বৃদ্ধরা বসে বসে দেখতেন প্রকৃতির এই মিলনমেলা।
নদী ও লোকসংস্কৃতি: নবগঙ্গার কবিতা ও কিংবদন্তি
নবগঙ্গা নদী কেবল প্রকৃতির উপহার নয়, এটি হয়ে উঠেছিল স্থানীয় মানুষের কল্পনা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আধার। এই নদী ঘিরে গড়ে উঠেছে বহু পালাগান, বাউলগান, মুর্শিদি ও লোককথা। নড়াইল ও যশোরের কবিয়ালরা নবগঙ্গাকে ঘিরে রচনা করেছেন শত শত পদ্য, গান ও আখ্যান। বাউলরা নদীর তীরে বসে গেয়েছেন—
“নবগঙ্গার জলে, ভেসে যায় মন,
চোখে দেখি সংসার, ভিতরে মনের গুঞ্জন।”
নদী ঘিরে প্রচলিত আছে নানা কাহিনি। এক রাক্ষসীর গল্প আছে, যিনি নাকি রাতের বেলা নদীতে ভেসে বেড়াত। তখন জেলেরা ভয় পেয়ে গান গাইতেন, নদীর দেবীর কাছে রক্ষা চাইতেন। আবার নবগঙ্গার পাড়েই কিছু পীর-আউলিয়ার অলৌকিক ঘটনার গল্পও ছড়িয়ে আছে—কারও দোয়া কবুল হতো, কেউ হঠাৎ রোগমুক্ত হতো—এই সবই নদীর সঙ্গে মিশে থাকা আঞ্চলিক বিশ্বাস।
নদী ও গ্রামীণ জীবন: জীবনের গতিপথে নবগঙ্গা
নবগঙ্গা ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কৃষি-সেচ থেকে শুরু করে মাছ ধরা, পানি সংগ্রহ, নদীপথে যাতায়াত—সব কিছুতেই ছিল নবগঙ্গার উপর নির্ভরতা। শিশুদের স্নান ও খেলাধুলা, নারীদের কাপড় ধোয়া, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা ও মহালয়ার সময় প্রতিমা বিসর্জন—সবই হতো এই নদীতে। গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে নবগঙ্গা ছিল কেন্দ্রবিন্দু, এক অনুপম জীবনের সঞ্চালক।
বর্তমান সংকট: নদী সংকুচিত, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
আজকের নবগঙ্গা তার আগের রূপ হারিয়েছে। নদী দখল, অপরিকল্পিত বাঁধ, বর্জ্য ফেলা, পলিভরাট ও দখলদারিত্বের কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক স্থানে নদী এখন শুকিয়ে খাল-আকৃতির হয়ে গেছে। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের বাকি সময় নদী যেন মৃতপ্রায়। মাছের প্রজাতি কমেছে, নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ, জমির উর্বরতা কমছে এবং পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
নবজাগরণের সম্ভাবনা: কী করতে হবে এখন?
নদী রক্ষা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। কিছু নদীপ্রেমী সংগঠন নবগঙ্গা খননের দাবি তুলেছে। নড়াইল, যশোর ও খুলনায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ এখনও ক্ষুদ্র পরিসরে। নদীটিকে সত্যিকার অর্থে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, নদী শুমারি, পুনর্খনন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, বাঁধ ব্যবস্থার সংস্কার ও সর্বস্তরের সমন্বিত উদ্যোগ।
নবগঙ্গা আমাদের ইতিহাস, আমাদের ভবিষ্যৎ
নবগঙ্গা নদী কেবল একটি জলধারা নয়—এটি একটি জনপদের ইতিহাস, একটি জীববৈচিত্র্যের আবাস, একটি সংস্কৃতির স্মারক এবং মানবিক আবেগের প্রতীক। এই নদী হারিয়ে গেলে শুধু পানি নয়, হারিয়ে যাবে গান, লোককথা, প্রজন্মের স্মৃতি এবং একটি অঞ্চল। নবগঙ্গাকে রক্ষা করা মানে, আমাদের নিজস্ব শিকড়কে রক্ষা করা।
নবগঙ্গা যদি কথা বলতে পারত, বলত—আমাকে ফেরাও আমার প্রাণ, আমার স্রোত, আমার গান।