জলের বাঘ: এক অনন্য অভিযোজিত বিড়াল
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী জগতের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রাণীগুলোর একটি হলো মেছোবাঘ। যদিও নামের শেষে “বাঘ” শব্দটি আছে, এই প্রাণীটি মূলত মাঝারি আকারের একটি বন্য বিড়াল, যার বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus।
বাংলায় “মেছোবাঘ” নামটি এসেছে এর বিশেষ খাদ্যাভ্যাস থেকে—এটি মাছ খায় এবং সাঁতারে পারদর্শী, যা বিড়াল প্রজাতির মধ্যে বিরল।
বাসস্থান: জলাভূমির নিঃশব্দ রাজা
মেছোবাঘ সাধারণত বাস করে জলাভূমি, হাওর-বাঁওড়, পানির ধারে ঝোপঝাড়, আদ্রভূমি, এমনকি সুন্দরবনের উপকূলীয় অংশেও দেখা মেলে। বাংলাদেশের রাজশাহী, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরগুনা ও খুলনা অঞ্চলে এই বিড়ালের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়।
যেখানে জল, পোকামাকড়, কাঁকড়া, ব্যাঙ আর মাছ আছে—সেখানেই মেছোবাঘ টিকে থাকতে পারে।

চেহারা ও বৈশিষ্ট্য
মেছোবাঘের দেহ ঘন বাদামি ছোপে ছোপে ছাপা দাগে ভরা। মাথা বড়, থুতনির কাছটা সাদা, কান তুলনামূলক ছোট এবং লেজ মোটা।
তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো—এদের পায়ের আঙুলের ফাঁকে পাতলা জালিকা (partial webbing) থাকে, যা এদের সাঁতার কাটা ও জলে হাঁটতে সাহায্য করে।
খাদ্যাভ্যাস: মাছেই জীবন
মেছোবাঘ মূলত নিশাচর ও একাকী জীব। রাতে জলের ধারে ধারে ঘুরে বেড়ায় মাছ ধরার জন্য। এরা মাছকে আঘাত করে কাবু করে, এবং মাঝে মাঝে পানি থেকে মাছ লাফ দিয়ে উঠলে এক লাফে ধরেও ফেলে।
তাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে:
- মাছ
- কাঁকড়া
- ব্যাঙ
- ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী
- পাখি
মেছোবাঘের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—জলে মাছ ধরার জন্য হঠাৎ ঝাঁপ দেওয়া। অনেক সময় দেখা যায়, ওরা পুকুরপাড়ে বসে থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, মাছ কাছে এলেই হঠাৎ থাবা মারে।

সংকট: জলাভূমি হারানো ও মানুষের ভয়
বাংলাদেশে জলাভূমির দ্রুত হ্রাস, পুকুর ভরাট, কৃষিজমিতে রাসায়নিকের ব্যবহার, এবং ঘনবসতির কারণে মেছোবাঘের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ হলো—মানুষের সঙ্গে সংঘাত। গ্রামে পুকুরে মাছ ধরতে এলে অনেক সময় মেছোবাঘ ধরা পড়ে, এবং মানুষ ভয়ে বা ক্ষোভে মেরে ফেলে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দুই সপ্তাহে গড়ে একটি মেছোবাঘ হত্যা হচ্ছে বাংলাদেশে, যার মধ্যে অধিকাংশই ঘটে মানুষের হাতে।
আইনি ও সংরক্ষণ অবস্থান
- IUCN-এর লাল তালিকায় মেছোবাঘ এখন ‘Vulnerable’ বা ঝুঁকিপূর্ণ।
- বাংলাদেশের বন আইন অনুযায়ী মেছোবাঘ শিকার, হত্যা বা পোষা অপরাধ।
- ২০২০ সাল থেকে বন বিভাগ ও কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন মেছোবাঘ রক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। কিছু কিছু এলাকায় মেছোবাঘ উদ্ধার করে আবার বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা, এবং বন বিভাগের জনবল ঘাটতি এ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে রেখেছে।

সচেতনতা: মূল চাবিকাঠি
মেছোবাঘ রক্ষায় প্রাথমিকভাবে যা দরকার তা হলো সচেতনতা। মানুষকে বুঝতে হবে—
- এটি ক্ষতিকর নয়
- গৃহপালিত প্রাণীর জন্য হুমকি নয়
- বরং এটি জলাশয়ের জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখে
গ্রামে পোস্টার, নাটিকা, বিদ্যালয়ে প্রকৃতি ক্লাব, এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালালে এই প্রাণীটির জন্য সহমর্মিতা গড়ে তোলা সম্ভব।
মেছোবাঘ প্রকৃতির এক নীরব যোদ্ধা। এটি শুধু মাছ ধরে না, বরং জলাভূমি ও বনজলাশয়ের সাম্য রক্ষা করে।
আমরা যদি চুপচাপ বসে থাকি, তবে হয়তো আগামী প্রজন্ম আর কখনও এই জলছুট বিড়ালের গল্প শুনবে না বাস্তব থেকে—শুধু বইয়ের পাতায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















