অভিযোগ ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দ্রুত তাদের নিজস্ব চিপ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তাদের আটকে দেয়নি—বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা উল্টো নিজস্ব বিকল্প তৈরির গতি বাড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনে দেখা যাবে কীভাবে কোম্পানিগুলো আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে বাড়তি স্বনির্ভরতার পথে এগোচ্ছে এবং এর আন্তর্জাতিক ও কৌশলগত প্রভাব কী হতে পারে।
বিকল্প তৈরির উদাহরণ: iFLYTEK ও Spark
চীনের এআই নির্মাতাদের মধ্যে iFLYTEK বিশেষ নজর কাড়ে। তারা আগে Nvidia-র চিপ ব্যবহার করে বড় ভাষাগত মডেল ট্রেনিং করতে চেয়েছিল, কিন্তু ২০১৯ সালে মার্কিন বাণিজ্য দফতরের ব্ল্যাকলিস্টিংয়ের পর তারা বিকল্প গড়ে তোলে এবং এখন দাবি করে তাদের নিজেদের মডেলই যথেষ্ট কার্যকর।
iFLYTEK তাদের ‘স্পার্ক’ লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল প্রদর্শন করছে—যা প্রশ্নের উত্তর দেয়, গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা তৈরি করে এবং শিক্ষকদের সময় বাঁচাতে পরীক্ষার লিখিত উত্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যায়নের মতো সিস্টেম চালায়। এসব সেবা দেশজুড়ে বহু স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও চীনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কন্টেন্ট সীমাবদ্ধতা মানতে হয়।
নিষেধাজ্ঞা থেকে টিকে ওঠা: স্থানীয় সহযোগিতা
iFLYTEK জানিয়েছে, তারা হুয়াওয়ের মতো দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে চিপ উন্নয়নে সহযোগিতা করেছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, হুয়াওয়ের চিপ এখন চীনের বাজারে শীর্ষস্থানীয় এবং iFLYTEK সেই চিপকে বড় ভাষাগত মডেলের জন্য উপযোগী করতে সক্ষম হয়েছে—যদিও এতে কিছুটা সময় লেগেছে।
এখানে বড় পয়েন্ট হলো: মার্কিন রফতানি নিয়ন্ত্রণ কিছু ক্ষেত্রে শিথিল হলেও এবার চীন নিজেই কিছু চিপ ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে, কারণ দেশীয় দক্ষতা দ্রুত বাড়ছে।
দ্রুত পরিবর্তন: ইয়াংৎসে ডেল্টা অঞ্চলের দৃশ্যপট
ইয়াংৎসে রিভার ডেল্টায় অঞ্চলভিত্তিক সফরে দেখা গেছে প্রযুক্তি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্রুতগতির পরিবর্তন। এই অঞ্চলের কয়েকটি প্রদেশের অর্থনীতি জার্মানির সমপর্যায়, এবং জনসংখ্যাও বিশাল। উচ্চগতির রেলপথে কয়েকদিনের সফরে শিল্পকারখানা, প্রদর্শনী ও পরিসংখ্যানে যে অগ্রগতি চোখে পড়ে তা উল্লেখযোগ্য—যদিও দেশের পুরো অর্থনীতি এখনো আধুনিক উৎপাদনে পুরোপুরি স্থানান্তরিত হয়নি।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসলে কতটা কার্যকর?
হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি, কিন্তু সাপ্লাই চেইন ও শুল্কনীতি দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা কোম্পানিগুলো—যেমন iFLYTEK—অভিযোগ করেছে যে এসব সিদ্ধান্ত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন থামায়নি; বরং নিজস্ব বিকল্প তৈরির দিকেই তাদের ত্বরান্বিত করেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, এই containment নীতি চীনের জন্য উল্টো স্বনির্ভরতা প্রদর্শনের একটি সুযোগ হিসেবে কাজ করেছে।

রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সমালোচনা
চীনের উচ্চ-প্রযুক্তি খাতকে রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সমর্থন করা হচ্ছে—সাবসিডি, কর সুবিধা, কনসেশন ও জমি প্রদানের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এসব নীতির সমতুল্য ব্যয় জাতীয় আউটপুটের কয়েক শতাংশের সমান, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
সমালোচকদের মতে, কিছু কোম্পানি “বহুাংশে ব্যক্তিগত হলেও প্রকৃতপক্ষে কম ব্যক্তিগত”—কারণ রাষ্ট্রীয় সুবিধা তাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় বাড়তি সুবিধা দেয়। পাশাপাশি, চীন শক্তিশালী অবকাঠামো বিনিয়োগ—নতুন সেতু, উন্নত শহর প্রকল্প ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র—থেকে বড় সুবিধা পাচ্ছে।
মানবসম্পদ ও ভিসা কৌশল
প্রযুক্তি খাত মূলত মানুষ ও দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে। চীন শিল্পক্ষেত্রে কর্মী আনার জন্য নতুন ভিসা নীতি চালু করেছে—বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের আকর্ষণ করতে—যা মার্কিন ভিসা চাপে প্রতিক্রিয়ামূলক বলে মনে করা হয়।
একই সঙ্গে, চীন বিদেশে থাকা নিজের প্রতিভাবান নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছে; প্রকৌশলী ও গবেষকদের দেশে ফেরাতে ও ধরে রাখতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বাজার কৌশল ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য
চীনের প্রযুক্তি ও ইলেকট্রিক যান (ইভি) নির্মাতারা এখন বৈশ্বিক বাজারে নজর দিচ্ছে। মার্কিন বাজারে অনিশ্চয়তা ও শুল্কনীতির ঝুঁকির কারণে অনেক কোম্পানি ইউরোপ, এশিয়া ও গ্লোবাল সাউথে বিক্রির দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ-প্রান্তের ইভি নির্মাতা NIO প্রধানত ইউরোপীয় বাজারে ফোকাস করছে এবং উৎপাদন লাইন অটোমেশন বাড়িয়ে ২০২৫ সালে ব্যাপক উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ব্যাটারি নির্মাতা ও অন্যান্য সরবরাহকারীরাও একই কৌশল অনুসরণ করছে—এক ব্যবস্থাপকের ভাষায়, “আমরা মূলত ইউরোপেই মনোযোগ দিচ্ছি।”
প্রতিযোগিতা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ
চীনের প্রযুক্তিগত সাফল্য উল্লেখযোগ্য হলেও তা পুরো অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে না—অধিকাংশ অংশই এখনো ঐতিহ্যগত খাতে নির্ভরশীল। পাশাপাশি প্রযুক্তি সবসময় কল্পনা অনুযায়ী কাজ করে না—কিছু উদ্যোগে বড় ত্রুটি, পরিবেশগত সমস্যা বা নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রদর্শনী বন্ধও হয়েছে।
তবে টেক সেক্টরের দ্রুত উত্থান আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল চীনের উচ্চ-প্রযুক্তির অগ্রগতি থামানো। তবে বাস্তবে তা চীনের স্বনির্ভরতা আরও বাড়িয়েছে—দেশীয় চিপ সক্ষমতা, এআই মডেল এবং বৈশ্বিক বাজার কৌশল আরও উন্নত ও দ্রুততর হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য, কৌশলগত ভারসাম্য ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে—এবং এখন প্রশ্ন হলো, এই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা কি বৈশ্বিক নতুন সমঝোতা ও কৌশলের জন্ম দেবে?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















