পরাজয়ের পরেও বিশ্লেষণের অভাব
কমলা হ্যারিস তার নির্বাচনী স্মৃতিকথা “১০৭ দিন” বইটিতে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবরের ঘটনা উল্লেখ করেন—যে দিনটি ছিল ট্রাম্পের কাছে তার পরাজয়ের মাত্র ষোল দিন আগে। তিনি লিখেছেন, তখন ভাবার সময় নেই, কাজ করে যেতে হবে। স্বীকারোক্তিতে তিনি আরও জানান যে তিনি কাজ-নির্ভর মানুষ, চিন্তার জন্য নিজের জন্য জায়গা রাখেন না।
এই বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি এখনও পরাজয়ের প্রকৃত কারণ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার পর্যায়ে পৌঁছাননি। বইটি সাজানো হয়েছে ডায়েরির আকারে, যেখানে ঘটনাগুলো শুধু ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছে, কিন্তু বিশ্লেষণ বা আত্মসমালোচনার গভীর কোনো উপস্থিতি নেই। এটি একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতার স্মৃতিচারণ হলেও, সেই ব্যর্থতা থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায় সে বিষয়ে বইটি নীরব।
ব্যর্থতার বর্ণনা, সমাধানের নয়
এই স্মৃতিকথা আমেরিকার বর্তমান গণতান্ত্রিক সংকটকে ব্যাখ্যা করে না। বরং এটি একটি মানসিক আঘাত-পরবর্তী অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির মতো। হ্যারিস লেখেন, পুরো বইটি লেখা যেন প্রচারণার পথকে আবার উল্টো দিকে হাঁটার মতো অনুভূতি দিচ্ছিল।
কিন্তু এমন এক সময়ে যখন দেশে প্রতিবাদকে অপরাধ করা হচ্ছে, সেনা রাস্তায় টহলে আছে, দমন-পীড়নের কাঠামো গড়ে উঠছে, তখন অতীত স্মৃতির পুনর্নির্মাণ নয়, ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ জরুরি।
ট্রাম্পের বিজয়ের কারণ
ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য যে তাৎক্ষণিক কারণগুলো দায়ী, সেগুলো এখন পরিষ্কার। হ্যারিসের উপদেষ্টা ডেভিড প্লুফে সতর্কভাবে বলেছিলেন, “মানুষ বাইডেনকে ঘৃণা করে।”
বাইডেন তখন অত্যন্ত অজনপ্রিয় ছিলেন। মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবন কঠিন হয়ে উঠেছিল, আর তার বড় সাফল্য—পরিকাঠামো সংস্কার বা সবুজ অর্থনীতির দিকে বড় বিনিয়োগ—সেগুলো জনমানসে পৌঁছায়নি। বয়সজনিত দুর্বলতা তাকে বাধা দিয়েছে, এবং দলীয় নেতৃত্ব এ দুর্বলতাকে উপেক্ষা করেছে।
প্রার্থিতা প্রত্যাহারে ব্যর্থতা ও দলের মর্যাদাহানি
বাইডেনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ অনেকের মনে থাকলেও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। হোয়াইট হাউসের সাবেক প্রধান স্টাফ বিল ডেলি বলেন, সবাই জানত বাইডেন দুর্বল হয়ে পড়েছেন, কিন্তু কেউ চ্যালেঞ্জ করতে সাহস করেনি।
হ্যারিস নিজের বইতে প্রশ্ন তোলেন তিনি কি বাইডেনকে সরে দাঁড়াতে বলার কথা ভাবা উচিত ছিল। তার উত্তর “হয়তো,” যা বাস্তবে একটি দায় এড়ানো উত্তর।
এই দ্বিধা ডেমোক্র্যাটদের ক্ষতি করেছে। ট্রাম্পকে মিথ্যাচারের জন্য অভিযুক্ত করতে গিয়ে নিজেদেরই অসত্ অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। ভোটাররা ভাবতে শুরু করে—যদি ট্রাম্প সত্যিই গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হন, তাহলে কেন ডেমোক্র্যাটরা শক্ত প্রার্থী দাঁড় করাতে এত দেরি করল?
হ্যারিস মনোনয়ন পাওয়ার পরও বাইডেনকে অতিরিক্ত প্রশংসা করে নিজের অবস্থান দুর্বল করেন। পরে সেটিই আত্মঘাতী হয়ে ওঠে।
আত্মঘাতী মন্তব্য ও ভুল কৌশল
এক জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি বাইডেনের জায়গায় কী ভিন্ন করতেন, তিনি উত্তর দেন, “একটাও কিছু মনে আসছে না।”
এই মন্তব্য তার প্রচারণার বড় ক্ষতি করে।
আরও বড় ভুল ছিল তার প্রস্তুতি-নোটে লেখা বক্তব্য—তিনি মন্ত্রিসভায় একজন রিপাবলিকান রাখতে চান। তিনি ভেবেছিলেন রিপাবলিকানদের কাছে নমনীয় বার্তা পাঠানোই ভোট পাওয়ার কৌশল। বাস্তবে এটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত।
বিভ্রম: দ্বিদলীয় সৌহার্দ্য দিয়ে ট্রাম্পকে থামানো যায় না
হ্যারিস পুরোনো যুগের দ্বিদলীয় সহযোগিতার প্রতি নস্টালজিক ছিলেন। এমনকি ডিক চেনির সমর্থন পাওয়াকে তিনি ‘সম্মান’ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইরাক যুদ্ধের স্থপতি চেনির সমর্থনকে মূল্যবান মনে করাই দেখায় হ্যারিস আসলে রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে কতটা দূরে ছিলেন।
ডেমোক্র্যাটরা আশা করেছিলেন কিছু রিপাবলিকান ভোট তাদের কাছে আসবে। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনে হ্যারিস মাত্র পাঁচ শতাংশ রিপাবলিকান ভোট পান—বাইডেন ও হিলারির থেকেও কম।
বিদেশনীতি ও নৈতিক দ্বৈততা: গাজা প্রশ্নে সংকট
গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ডেমোক্র্যাটদের নীরবতা তাদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে।
হ্যারিস উল্লেখ করেছেন, তিনি বাইডেনকে অনুরোধ করেছিলেন গাজার বেসামরিক হতাহতদের প্রতিও একই সহমর্মিতা দেখাতে, যেমনটি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে ডেমোক্র্যাট কনভেনশনে গাজা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়, এবং কোনো প্যালেস্টাইনি বক্তাকে জায়গা দেওয়া হয়নি।
এই দ্বৈততা যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বল ও দ্বিধাগ্রস্ত হিসেবে তুলে ধরে। ট্রাম্প যে নির্মম রাজনীতি তৈরি করেছেন, তার বিপরীতে ডেমোক্র্যাটরা শুধু করুণা ভিত্তিক ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের আরও দুর্বল করে ফেলেছে।
আমেরিকার নৈতিক ভিত্তিতে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন
এলেনর রুজভেল্টের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল মানবাধিকার বিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণা।
ডেমোক্র্যাটদের সেই নৈতিক ভিত্তিতে ফিরে যেতে হবে, যাতে দেশ-বিদেশে তাদের অবস্থান সুসংহত হয়।
ট্রাম্পের মূল্যবোধহীন বৈদেশিক নীতির বিপরীতে দাঁড়াতে হলে দৃঢ়, ধারাবাহিক এবং নীতিগত অবস্থান অপরিহার্য।
ট্রাম্প কি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করছেন?
ইতিহাসবিদ গ্যারি গারস্টল বলেন, একসময় রাজনৈতিক ধারণা এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে বিরোধী দলও তার কাঠামো মেনে চলতে বাধ্য হয়। তখন সেটিই রাজনৈতিক শাসনের ধরন হয়ে দাঁড়ায়।
নিউ ডিল যুগে রিপাবলিকানরা সেটি মেনে নিয়েছিল। নবউদারনীতির সময় ডেমোক্র্যাটরা সেটি গ্রহণ করেছিল।
এখন প্রশ্ন—ট্রাম্প কি সেই ধরনের শাসনব্যবস্থা তৈরি করছেন?
ট্রাম্প ইতোমধ্যে পুরো রাজনৈতিক পরিসরকে ডানের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটদের পুরোনো মধ্যপন্থা এখন অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে।
‘মাঝামাঝি পথ’ ভেঙে পড়া
জলবায়ু সংকট, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বিচারব্যবস্থার ওপর আক্রমণ—এগুলোর বিপরীতে কোনো “মাঝামাঝি” পথ নেই।
ট্রাম্পের ভাষ্যে ডেমোক্র্যাটরা সবসময়ই “চরম বাম।”
সুতরাং ডেমোক্র্যাটদের সামনে পথ দুটি—
মধ্যপন্থী প্রমাণের বৃথা চেষ্টা চালানো,
অথবা
সাহসী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করা।
অপেক্ষা করে নয়—প্রতিরোধেই ভবিষ্যৎ
কিছু ডেমোক্র্যাট কৌশলী পরামর্শ দিয়েছিলেন—ট্রাম্প নিজেই ভেঙে পড়বেন, তাই ডেমোক্র্যাটদের নীরব থাকা উচিত।
এই ধারণা বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
কারণ ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, আইনসভা ও বেসামরিক সমাজের ওপর শক্ত প্রভাব তৈরি করছেন।
গণতন্ত্র নিষ্ক্রিয় থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য।
অর্থনৈতিক ধস গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে না
অনেকে আশা করেন ট্রাম্পের নীতি অর্থনৈতিক ধস নামাবে এবং জনগণ তখন ডেমোক্র্যাটদের দিকে ফিরবে।
ইতিহাস দেখায় অর্থনৈতিক সংকট প্রায়ই ডানপন্থী শক্তিকে আরও আক্রমণাত্মক করে তোলে।
এই সময়ে যদি গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তবে রাজনৈতিক দোলনা আর কখনো পিছনে ফিরবে না।
পুরোনো দলীয় কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে
দলভিত্তিক গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ট্রাম্প রিপাবলিকান দলকে আন্দোলনে পরিণত করেছেন, কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা পরিবর্তনের এই ধারা ধরতে পারেনি।
হ্যারিস নিজেও স্বীকার করেন, “ব্যবস্থার ভেতরে কাজ করা যথেষ্ট নয়,” কিন্তু ব্যবস্থার বাইরে নতুন রাজনৈতিক পথ কল্পনা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
নতুন প্রজন্মের রাজনীতি: মমদানি মডেল
জোহরান মমদানির নিউইয়র্ক মেয়র প্রচারণা দেখিয়েছে, জনগণের শক্তি দলীয় কাঠামোর বাইরে থেকেও সংগঠিত হতে পারে।
কিন্তু দলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের প্রার্থীকেই সমর্থন দিতে ভয় পেয়েছেন।
এমন নেতৃত্ব রাজনৈতিক ভবিষ্যতের পথ নিজেদেরই বন্ধ করে দেয়।
রাগকে শক্তিতে পরিণত করা
ট্রাম্প রাগকে শক্তির উৎস বানিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটরা ভুল ধারণা করেছিলেন যে ইতিবাচক অনুভূতি দিয়ে রাগকে প্রতিহত করা যায়।
কিন্তু রাগকে ন্যায়ের পথে ব্যবহার করতে পারলে তা পরিবর্তনের শক্তি হয়।
অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রজন্মান্তরের স্থবিরতা, করপোরেট ক্ষমতা—এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ সংগঠিত হলে তবেই গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
বৈষম্যের গভীর সংকট
শীর্ষ ০.১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ১৪ শতাংশ সম্পদ। নিচের অর্ধেক মানুষের কাছে মাত্র ২.৫ শতাংশ।
এ বৈষম্য গণতন্ত্রকে ভেঙে দিচ্ছে।
প্রজন্মান্তরের অগ্রগতিও স্থবির হয়ে গেছে—অনেকেই বাবা-মায়ের চেয়ে দরিদ্র হয়ে বড় হচ্ছে।
‘সমতা’ ও ‘অলিগার্কি’ বলতে ডেমোক্র্যাটদের ভয়
হ্যারিস সমতা নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য নিয়ে নীরব থেকেছেন।
স্যান্ডার্স ও ওকাসিও-কর্টেজ স্পষ্টভাবে বলেন—এ দেশে অলিগার্কি তৈরি হয়েছে।
ডেমোক্র্যাটরা ভেবেছিলেন টেক ধনীরা হয়তো তাদের মিত্র হবে।
কিন্তু বাস্তবে এ ধনীরা চরম ডানপন্থায় ঝুঁকেছে।
তৃতীয় পথ ব্যর্থ—শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির প্রয়োজন
টনি ব্লেয়ারের “ধনী হলে সমস্যা নেই, যদি কর দেয়” ধারণা ভেঙে গেছে।
ধনীরা কর এড়িয়ে সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ডেমোক্র্যাটদের আবার শ্রমজীবী শ্রেণির বাস্তব সমস্যায় ফিরে যেতে হবে।
শ্রমজীবীদের পক্ষে কথা বলা নয়, বরং যেসব শক্তি তাদের শোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই হবে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তি।
নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা: আপনি কাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন?
আজকের সমাজে সবাই নিজের কথা বলতে পারে।
তাই জনগণের কাছে বড় প্রশ্ন—একজন নেতা কার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস রাখেন?
ধনীদের বিরুদ্ধে?
করপোরেট ক্ষমতার বিরুদ্ধে?
বৈষম্যের বিরুদ্ধে?
যিনি এ ঝুঁকি নিতে পারেন তিনিই প্রকৃত নেতা।
গণতন্ত্রের সামনে শেষ সতর্কতা
আমেরিকার গণতন্ত্র এখন সংকটের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে।
ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হলো গণতান্ত্রিক দোলনাকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া।
এ অবস্থায় নিরপেক্ষ থাকার জায়গা নেই।
যারা নীরব থাকে তারা রক্ষা পায় না।
প্রতিরোধই একমাত্র পথ—
এই প্রতিরোধই আমেরিকার জন্মের ভিত্তি ছিল।
দেশের ২৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে।
এটি হয় পুনর্জাগরণের, নয় পতনের নির্দেশক হয়ে দাঁড়াবে।
বশ্যতা নয়—প্রতিরোধই আমেরিকার শেষ আলো।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


:max_bytes(150000):strip_icc():focal(745x438:747x440)/107-Days-Kamala-Harris-073125-tout-5dae63147afa40ccae2947590cb60c14.jpg)


















