জ্বালানি রূপান্তর ও অর্থায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা
ব্রাজিলের আমাজন নগরী বেলেমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কোপ৩০ এখন সবচেয়ে স্পর্শকাতর পর্যায়ে ঢুকেছে। প্রথম সপ্তাহে টেকনিক্যাল আলোচনায় খসড়া নথি কিছুটা এগোলেও, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ ও জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে এখনও স্পষ্ট ভাষা আসেনি। মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিরা একে এখন “ডেলিভারি সপ্তাহ” বলছেন—এই কয়েক দিনে সমঝোতা না হলে সম্মেলন আরেকটি ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে যেতে পারে।
দ্য জাপান টাইমসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আলোচনায় পুরনো দ্বন্দ্বই নতুন করে মাথা তুলেছে। উন্নত দেশগুলো চাইছে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোও দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিক, কারণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য ধরে রাখার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বিপরীতে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর যুক্তি—তারা এখনও দারিদ্র্য, অবকাঠামো ঘাটতি ও ঋণের বোঝায় জর্জরিত; পর্যাপ্ত এবং নিশ্চিত অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ঋণ-সহায়তার রূপরেখা ছাড়া তারা কঠিন প্রতিশ্রুতিতে যেতে পারবে না।
ফসিল জ্বালানি, ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ ও আমাজনের বার্তা
সবচেয়ে বড় বিতর্ক চলছে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একজোট জোট ও কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র সমাপনী ঘোষণায় স্পষ্ট ‘ফেজ-আউট’ বা ধাপে ধাপে ব্যবহার বন্ধের ভাষা দেখতে চায়। বিপরীতে প্রধান উৎপাদক ও কিছু বড় অর্থনীতি ‘ফেজ-ডাউন’ বা নিয়ন্ত্রিত কমানোর মতো নরম শব্দ ব্যবহার করতে চাইছে, যেখানে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির ওপরও জোর থাকে। নাগরিক সমাজের আশঙ্কা, দুর্বল ভাষা ব্যবহার করা হলে নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে, অথচ বাস্তবে তাপপ্রবাহ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি দিন দিন বেড়েই চলবে।
অর্থায়নের প্রশ্নটিও কম জটিল নয়। অতীতের অঙ্গীকারগুলো পূর্ণমাত্রায় না আসায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভরসা নড়বড়ে; তারা এবারের ঘোষণায় পরিষ্কার সংখ্যা, সময়সূচি ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা চাইছে। শুধু নির্গমন কমানো নয়, অভিযোজন–সংক্রান্ত খাতে—যেমন আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি—কত অর্থ আসবে, তা স্পষ্ট না হলে তারা চূড়ান্ত নথিতে সই করতে অনীহা প্রকাশ করছে। একই সঙ্গে “লস অ্যান্ড ড্যামেজ” তহবিল নিয়ে আলোচনা জোরালো হচ্ছে; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা স্থায়ী ক্ষতির মুখে থাকা দ্বীপ ও উপকূলীয় দেশগুলো এর মাধ্যমে বাস্তব ক্ষতিপূরণের পথ দেখতে চায়।

আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিল একদিকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে, অন্যদিকে নিজেদের জলবায়ু সাফল্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে। সরকার বলছে, আমাজনে বন ধ্বংসের হার সাম্প্রতিক বছরে কমেছে এবং সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত নতুন বন সংরক্ষণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকা জুড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে বিনিয়োগ বাড়াতে আঞ্চলিক এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপের কথাও তারা সামনে আনছে। তবে স্থানীয় আদিবাসী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের অভিযোগ, নতুন প্রকল্পের অনেকগুলোতেই এখনো পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা নেই, আর জমি-অধিকার ও পরিবেশবিষয়ক সুরক্ষা যথেষ্ট শক্ত নয়।
বেলেমের রাস্তায় এবং সম্মেলন-কেন্দ্রের ভেতরে বিভিন্ন সংগঠন সমান্তরাল কর্মসূচির মাধ্যমে আলোচকদের ওপর চাপ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তরুণদের জলবায়ু আন্দোলন নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্পের বিরোধিতা করে মিছিল করছে; বিজ্ঞানীরা একের পর এক গবেষণা তুলে ধরে বলছেন, দেরি হলে অনেক ঝুঁকিই অপরিবর্তনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের কেউ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দাবি করছে, আবার কেউ গ্যাস ও কার্বন ক্যাপচারের জায়গা ধরে রাখতে তদবিরে ব্যস্ত।
শেষ সপ্তাহে প্রশ্নটা এখন পরিচিত—কতটা উচ্চাভিলাষী ভাষা রাখা যাবে, যাতে প্রয়োজনে সবাই তা মেনে নেয়। অনেক কূটনীতিকই বলছেন, সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে এমন একটি সমঝোতা, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির যুগ শেষ হওয়ার বার্তাটি স্পষ্ট থাকবে, কিন্তু বাস্তবায়নের পথ বেছে নেওয়ার কিছুটা স্বাধীনতা থাকবে দেশগুলোর হাতে। নিম্নভূমি দ্বীপ ও খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য এই সম্মেলন কেবল কূটনৈতিক ইভেন্ট নয়; তাদের কাছে এটি জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। বেলেমের এই বৈঠক সেই বার্তা কত দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে, তার উত্তর মিলবে শেষ প্লেনারিতে গ্যাভেল পড়ার মুহূর্তেই।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















