ডব্লিউএফপির নতুন সতর্কতা ও তহবিল সংকট
জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) নতুন গ্লোবাল আউটলুক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী বছরে বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে থাকা মানুষের সংখ্যা মহামারির আগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। সংস্থাটি বলছে, সংঘাত, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা মিলিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে অনেক দেশের জন্য নিয়মিত খাদ্য জোগাড়ই কঠিন হয়ে পড়ছে। একই সময়ে ডব্লিউএফপির নিজস্ব তহবিল ইতিহাসের অন্যতম বড় সংকটে পড়েছে, ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো ছাড়া অনেক স্থানে রেশন কমাতে বা বন্ধ করতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বিশ্বজুড়ে কয়েকশ’ মিলিয়ন মানুষ সংকট বা তার চেয়েও মারাত্মক পর্যায়ের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হতে পারে। ডব্লিউএফপি পরিকল্পনা অনুযায়ী শত মিলিয়নের বেশি মানুষকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেকেরও কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে সংস্থাটি বহু দেশে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে; কোথাও পুরো রেশন বন্ধ হচ্ছে, কোথাও পরিবারপ্রতি সহায়তার পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নেমে যাচ্ছে।
গাজা উপত্যকা, সুদানের নানা অঞ্চল ও সাহেল অঞ্চলের কয়েকটি দেশে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র আকার নিয়েছে। কোথাও অবরোধ, কোথাও অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মধ্যে বাজার ও সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে গাজা ও সুদানের কিছু অংশে দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পরিস্থিতি নথিবদ্ধ করেছে। ডব্লিউএফপি বলছে, এসব এলাকায় তাদের প্রতিটি ত্রাণবাহী ট্রাক সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছে; সামান্য বিলম্বও মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
![]()
সংকটের পেছনে দাতা-ঘাটতি ও জলবায়ু আঘাত
ডব্লিউএফপি তহবিল ঘাটতির মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করছে ঐতিহ্যগত বড় দাতাদের অঙ্গীকার কমে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রধান দেশ বৈদেশিক সহায়তা কমিয়েছে, অন্যরা বাজেট চাপ ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের কারণে মানবিক খাতে কাটছাঁট করেছে। সংস্থাটি আগেই সতর্ক করেছে, ২০২৫ সালে তাদের মোট তহবিল আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে, যা বৈশ্বিক কর্মসূচির বিস্তৃত অংশকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
এর সঙ্গে নতুন করে আঘাত হানছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ। আফ্রিকার শুষ্ক অঞ্চল থেকে এশিয়ার বন্যাপ্রবণ উপকূল, ক্যারিবীয় ঘূর্ণিঝড় থেকে লাতিন আমেরিকার ঝড়–বন্যা—ঘনঘন দুর্যোগের কারণে কৃষিজ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, গবাদি পশু মারা যাচ্ছে, মানুষের সঞ্চয় ও সম্পদ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরিবার একের পর এক আঘাত সামলে ওঠার আগেই আবার নতুন দুর্যোগের মুখে পড়ছে, ফলে তারা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর।
ডব্লিউএফপি বলছে, শুধু জরুরি খাদ্য বিতরণ দিয়ে এই দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জরুরি ত্রাণের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে টেকসই সমাধানে বিনিয়োগ জরুরি—যেমন সেচব্যবস্থা ও গ্রামীণ সড়ক পুনর্গঠন, জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, স্কুলমিল ও নগদ সহায়তা কর্মসূচি। সংস্থাটি উল্লেখ করছে, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে একটি দেশের জন্য পরবর্তীতে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যয় অনেক কমে যায়।
ডব্লিউএফপির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন বিভিন্ন বক্তব্যে বিশ্বনেতাদের সতর্ক করে বলেছেন, খাদ্য সংকট এখন শুধু মানবিক নয়, নিরাপত্তা ইস্যুতেও পরিণত হয়েছে। তিনি মনে করেন, লাখ লাখ মানুষকে দীর্ঘ সময় অনিশ্চিত অবস্থায় না রেখে খাদ্য নিশ্চয়তা দেওয়া না গেলে, তা আরও সংঘাত, সহিংসতা ও বৈশ্বিক অভিবাসনের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। সংস্থাটি যতই প্রযুক্তি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করুক, এত বড় ঘাটতি শুধুই অভ্যন্তরীণ সংস্কারে পূরণ সম্ভব নয় বলেই তাদের মত। শেষ পর্যন্ত এটি রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের প্রশ্ন—বিশ্ব কি ক্রমাগত ক্ষুধাকে স্বাভাবিক বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেবে, নাকি শূন্য ক্ষুধা লক্ষ্যকে আবারও গুরুত্ব দেবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















