বিশ্বের নানা দেশে যুবকদের বিক্ষোভ শিরোনাম দখল করছে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই আন্দোলনগুলো কি বাস্তব এবং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারবে? জেনারেশন জেড-এর এই নতুন ঢেউ একদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
মাদাগাস্কার থেকে মরক্কো: ক্ষোভের আগুন
মাদাগাস্কারে সেপ্টেম্বর থেকে পানি-বিদ্যুৎ সংকট, বেকারত্ব ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা রাজধানী ছেড়ে সরে যান, এবং সামরিক নেতৃত্ব অস্থায়ী সরকার গঠন করে। এই পরিবর্তন নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে—এটি কি জনগণের দাবিকে প্রতিফলিত করে, নাকি ক্ষমতার নতুন কেন্দ্রীকরণ?
নেপালে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতায়। এতে অন্তত ১৯ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন কার্যত বাস্তবায়িত হয়নি।
মরক্কোতে ব্যাপক বেকারত্ব, অসমতা এবং ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রতিবাদে তরুণদের আন্দোলন জোরদার হয়েছে। নেতৃত্বহীন হলেও Gen Z 212 নামের নেটওয়ার্কভিত্তিক তরুণ দলটি আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি—জবাবদিহিতা ও ন্যায্য ব্যয়নীতি।
ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি দুর্নীতি এবং সংসদ সদস্যদের বিলাসী সুবিধার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আগস্ট থেকে বিক্ষোভ করছে। যদিও আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক বিতর্ক এখনও তীব্র। নিচু স্বরে হলেও তরুণদের অসন্তোষ অব্যাহত রয়েছে।
প্রজন্মের নতুন ভাষা: সংযোগ, মিম এবং নেতৃত্বহীন আন্দোলন
জেনারেশন জেড-এর বিক্ষোভগুলো আগের সব আন্দোলনের চেয়ে আলাদা। এখানে কোনো ঐতিহ্যগত নেতা নেই; সবকিছু স্বতঃস্ফূর্ত, নেটওয়ার্কভিত্তিক এবং ডিজিটাল সংস্কৃতিনির্ভর। ইন্টারনেট ভাষা, পপ কালচার ও মিম তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র। ওয়ান পিস–এর পাইরেট পতাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফ্যানডম চিহ্ন—সবকিছুই প্রতিবাদের নতুন প্রতীক হয়ে উঠছে। এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ তাদের সংগঠনের প্রধান মাধ্যম।
সংযোগ এত দ্রুত যে অ্যান্টানানারিভোর একটি আন্দোলন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাঠমান্ডু বা রাবাতের রাস্তায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে নেতৃত্বহীনতার কারণে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বা একক দাবি গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আন্দোলনের সঙ্গে আরব বসন্তের উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। দুটিই তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত, সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর এবং দুর্নীতিবিরোধী। তবে পার্থক্য হলো—এবারের আন্দোলন এক অঞ্চলভিত্তিক নয়; এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। লক্ষ্যেও পরিবর্তন এসেছে—আদর্শবাদ নয়, বরং অর্থনৈতিক মর্যাদা, কাজের সুযোগ ও সরকারের দায়বদ্ধতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফশিন মোলাভি বলেন—তাদের দাবি খুব সাধারণ: সম্মানজনক জীবিকা, কর্মসংস্থান এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ সরকার।
পরিবর্তনের অপেক্ষা: তারপর কী?
মাদাগাস্কারের আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রশংসনীয় হলেও আশঙ্কা রয়েছে—সামরিক নেতৃত্ব প্রকৃত দাবিগুলোকে আড়াল করে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারে।
নেপালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরও জনগণ পুরোপুরি আশ্বস্ত নয়। পুরনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে।
ইন্দোনেশিয়ায় কিছু জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দিকে টানতে শুরু করেছে, ফলে আন্দোলনের আগের গতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
মরক্কোতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চললেও সরকার সতর্কবার্তা দিচ্ছে। জনগণের ক্ষোভ এখন আর একটি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি বিস্তৃত সামাজিক অসন্তোষের প্রকাশ।
সংঘবদ্ধতার শক্তি ও ঝুঁকি
জেনারেশন জেড আন্তর্জাতিক সংযোগ ও অনলাইন সহযোগিতার নতুন ধারা গড়ে তুলেছে, যা একসময়কার মিল্ক-টি অ্যালায়েন্সের উন্নত রূপ বলা যায়। তবে এই উন্মুক্ততা ও নেতৃত্বহীনতা আন্দোলনকে বিভক্ত করে ফেলতে পারে। ভাইরাল শক্তির ওপর নির্ভরতা আন্দোলনকে দ্রুত বড় করে তোলে, আবার একই গতিতে তা ম্লানও করে দিতে পারে।
সংগ্রাম থেকে সংস্কার: সম্ভাবনা ও সন্দেহ
বিশ্লেষক প্লিটসাস মনে করেন—শক্তিশালী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এমন আন্দোলন সহজেই ভেঙে যেতে পারে, যেমনটি আরব বসন্তের পর দেখা গেছে। তবে অনলাইন সংযোগের কারণে জেনারেশন জেড কিছুটা বেশি দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
মোলাভির মতে, আজকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হলো “না-র দল”—যারা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ক্ষোভে ঐক্যবদ্ধ। তারা বাম বা ডান—যার কাছেই সামান্য প্রতিশ্রুতি পায়, সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
এই বিক্ষোভগুলোর ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। সফল পরিবর্তন নাকি আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া—দুটো সম্ভাবনাই সামনে রয়েছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এক বৈশ্বিক প্রজন্মের ক্ষোভের সম্মিলিত আওয়াজ।
এক তরুণ বিক্ষোভকারীর ভাষায়—
“আমরা সারাজীবন পর্দায় পৃথিবীকে দেখেছি। এবার আমরা নিজের হাতেই সেটা বদলাতে চাই।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















