যুক্তরাজ্যের লেবার সরকার নতুন কঠোর আশ্রয় (অ্যাসাইলাম) নীতি আনতে যাচ্ছে, যা শিশু ও পরিবারকে ব্যাপকভাবে বহিষ্কারের পথ খুলে দিতে পারে। এ নিয়ে লেবার দলেই তীব্র আপত্তি দেখা দিয়েছে। অনেক এমপি বলেছেন, এই নীতি দূর-ডানপন্থী ভাবধারার দিকে ঝুঁকে যায় এবং মানবিক মূল্যবোধকে আঘাত করে।
লেবার দলের নেতা কিয়ার স্টারমার নিজ দলের ভেতরেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। হোম সেক্রেটারি শবানা মাহমুদ আশ্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা মানবাধিকার আইনের ব্যাখ্যা পর্যন্ত পাল্টানোর ইঙ্গিত দেয়।
নীতি প্রস্তাব: কী পরিবর্তন আনতে চায় সরকার?
পরিবার-সহ শিশুদের জোরপূর্বক বহিষ্কার
যেসব পরিবারকে যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং যারা স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার জন্য প্রস্তাবিত অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, তাদের সরাসরি বহিষ্কারের পরিকল্পনা রয়েছে।
শরণার্থীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সম্ভাবনা
অ্যাসাইলাম প্রক্রিয়ার খরচ মেটাতে শরণার্থীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ধারণা উত্থাপিত হয়েছে, যা দলেই ক্ষোভ তৈরি করেছে। পরে সরকার জানায়, তারা শরণার্থীদের গয়না বাজেয়াপ্ত করবে না।
মানবাধিকার আইনের ব্যাখ্যা পরিবর্তনের উদ্যোগ
ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদের (ECHR) ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ—পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার—যা বহিষ্কার ঠেকাতে ব্যবহার হয়, তা সীমিত করতে চায় সরকার।
৩ নম্বর অনুচ্ছেদ—যা নির্যাতন বা অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ করে—সেটিও পুনর্বিবেচনার জন্য লবিং করার পরিকল্পনা রয়েছে।
শরণার্থী মর্যাদা সাময়িক করা
শরণার্থী মর্যাদা এখন থেকে স্থায়ী থাকবে না। প্রতি ৩০ মাস পরপর তা পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।
বহিষ্কার দ্রুততর করতে নতুন আপিল সংস্থা
বহিষ্কারের গতি বাড়াতে একটি নতুন আপিল সংস্থা গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে।
লেবার এমপিদের তীব্র আপত্তি
প্রায় ২০ জন লেবার এমপি প্রকাশ্যে এই নীতির বিরোধিতা করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন টনি ভগান, সারা ওয়েন, সাইমন অফার, আবতিসাম মোহাম্মদ এবং নিল ডানকান-জর্ডান।
শিশুদের আটক ও বহিষ্কার প্রসঙ্গে এক এমপি বলেন,
“আমি লেবার প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়িনি শিশুদের বিমানে তুলে বহিষ্কার করার জন্য।”
আরেক এমপি মন্তব্য করেন,
“এগুলো সরাসরি দূর-ডানপন্থী রাজনীতির নকল।”
মাহমুদের প্রতিক্রিয়া: ‘বিভাজনমূলক ভাষা নয়’
হোম সেক্রেটারি মাহমুদ বলেন, তাকে প্রায়ই বর্ণবিদ্বেষমূলক গালি শুনতে হয়—‘নিজ দেশে ফিরে যাও’। তিনি জানান, তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানেন, আশ্রয় বিষয়টি কতটা বিভাজন তৈরি করেছে।
তার দাবি,
“সীমান্ত সংকট এখন মূলধারার দলগুলোর জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই সমস্যা সমাধান না হলে আরও অন্ধকার রাজনৈতিক শক্তি সামনে আসবে।”
নীতির বিরুদ্ধে মানবিক ও নৈতিক যুক্তি
এমপিদের মতামত
একজন এমপি বলেন, এটি “নৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি সিদ্ধান্ত”—কারণ এতে পরিবার-সহ শিশুদের আরও আটক ও বহিষ্কার হবে।
সারা ওয়েন মন্তব্য করেন, “শরণার্থীরা মানুষ—যুদ্ধ ও নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসেছে।”
ডানকান-জর্ডানের মতে, “এভাবে বহিষ্কার ব্রিটিশ মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না।”
শরণার্থী কাউন্সিলের সতর্কতা
শরণার্থী কাউন্সিলের প্রধান এনভার সলোমন বলেছেন,
“এই প্রস্তাবগুলোর পেছনে রয়েছে যুদ্ধ ও নির্যাতন থেকে বেঁচে আসা মানুষজন। সংস্কারের ফলে কঠিন পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে—বিলম্ব বাড়বে, মানসিক চাপ বাড়বে এবং মানবিক আচরণ কমবে।”
দলীয় বিভাজন ও রাজনৈতিক হিসাব
অনেক লেবার সহকারী মনে করেন, সরকার কিছু নীতি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হবে।
উদ্বেগ রয়েছে যে ২০ বছরের স্থায়ী বাসিন্দা হতে অপেক্ষার সময় অত্যন্ত দীর্ঘ।
এমপিরা বলছেন, যুক্তরাজ্য শরণার্থীদের ‘প্রথম পছন্দ’ নয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী দেশটি ১৪-তম স্থানে।
তবু কিছু এমপি মনে করেন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য, কারণ রিফর্ম ইউকে’র উত্থান ভবিষ্যতে আরও দূর-ডানপন্থী সিদ্ধান্তের ঝুঁকি তৈরি করছে।
এক মন্ত্রীর ভাষায়,
“জনগণের মনোভাব বদলে গেছে। গত দশকে প্রচুর মানুষের স্থানচ্যুতি হওয়ার কারণে ‘যোগ্য শরণার্থী’ ধারণাটাই বদলে গেছে।”
লেবার সরকারের কঠোর আশ্রয় নীতি দলীয় ভেতরে বড়সড় বিভাজন তৈরি করেছে। কেউ মনে করেন এটি প্রয়োজনীয়, আবার কেউ বলেন এটি মানবিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মানবাধিকার সীমিত করা, বারবার যাচাই, পরিবার-সহ বহিষ্কার—সব মিলিয়ে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন ব্যবস্থা এখন নতুন বিতর্কের কেন্দ্র।
#রাজনীতি # যুক্তরাজ্য #লেবার-দল #আশ্রয়-নীতি #কিয়ার-স্টারমার #শবানা-মাহমুদ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















