‘শুধু’ জার্সি নয়
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর জার্সি এখন অর্থনীতি, বৈশ্বিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, ইমেজ গঠন ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের প্রতীক। জোয়ি দ’উরসোর বই More Than A Shirt দেখায়—জার্সির সামনে থাকা ব্র্যান্ড নামগুলো শুধু বাণিজ্য নয়; এগুলো জানিয়ে দেয় কে অর্থ ঢালছে, কোন রাষ্ট্র বা খাত কী বার্তা ছড়াতে চায়, আর কোন শূন্য নজরদারির ফাঁকে সমর্থকরা ঝুঁকিতে পড়ছে।
ক্লাব ও ট্রফি: অর্থের ক্ষুধা
১৩ জুলাই চেলসি প্যারিস সাঁ জারমাঁকে তিন গোলে হারিয়ে ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে। বিশাল স্বর্ণালি ট্রফি ও প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার আয়ের পাশাপাশি তারা পায় বাড়তি আত্মমর্যাদা—টুর্নামেন্টের প্রধান ফেবারিটকে পরাজিত করার গৌরব। কিন্তু সেই উল্লাসের মাঝেই স্পষ্ট দেখা যায় তাদের জার্সির সামনের ফাঁকা অংশ: বড় স্পন্সরের অভাব। ২০২২ সালে আমেরিকান কনসোর্টিয়াম মালিকানা নেওয়ার পর থেকে চেলসি স্থিতিশীল লাভজনক চুক্তি খুঁজছে। বিপরীতে পিএসজি প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন ডলার পাচ্ছে কাতার এয়ারওয়েজ থেকে—ক্লাব ও স্পন্সর দুটোই কাতারি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে।
সরল অতীত থেকে জটিল বর্তমান
প্রিমিয়ার লিগ শুরুর (১৯৯২) সময় লিভারপুলের সামনে ছিল বিয়ার ব্র্যান্ড, আর্সেনালের ছিল ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি—স্থানীয় বা ভোক্তা পণ্যনির্ভর সোজাসাপটা চুক্তি। বিশ্বায়নের সঙ্গে ক্লাবের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় শীর্ষ দলের জার্সিতে বহুমুখী, দূরভিসন্ধিমূলক বা ভাবমূর্তিনির্মাণকেন্দ্রিক স্পন্সর যোগ হতে শুরু করে।
ভূ-রাজনীতি ঢুকে পড়া: গ্যাজপ্রম উদাহরণ
২০০৬ সালে জার্মানির শীর্ষ পর্যায়ের দল শালকে ০৪ স্থানীয় একটি বীমা কোম্পানির বদলে রুশ গ্যাস উৎপাদক গ্যাজপ্রমকে সামনে আনে। সাধারণ দর্শক গ্যাসের ‘ঘনমিটার’ কিনতে যাবে না—তবু এই উচ্চমূল্যের চুক্তির লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে ‘বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী’ হিসেবে উপস্থাপন করা। এর সঙ্গে সমান্তরালে জার্মান জ্বালানি মিশ্রণে রুশ প্রাকৃতিক গ্যাসের অংশ বাড়তে থাকে—ইমেজ ও বাণিজ্য একসাথে এগোয়।
যাচাইহীন চুক্তি ও অস্বচ্ছতা
বইটির শক্তিশালী অংশ দেখায় অনেক ক্লাব পর্যাপ্ত যাচাই ছাড়া টাকা নিচ্ছে। ২০২১ সালে চেলসি লেয়ু স্পোর্টস নামে এক এশীয় অনলাইন জুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। খেলোয়াড়দের দিয়ে চীনা ভাষায় প্রচারণা ভিডিও বানানো হয়; স্টেডিয়ামে লোগো দেখা যায়। কিন্তু লেখক যখন চুক্তির মধ্যস্থকারী দাবি করা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজতে যান, প্রমাণ পান না। কর্মীদের ছবিও স্টক ফটো। উপসংহার: কে পরিচালনা করছে কেউ জানে না। ইচ্ছাকৃত প্রতারণা না হয়ে থাকলেও ‘অজ্ঞতা’ কার্যত একই ঝুঁকি সৃষ্টি করে—ক্লাব জানে না তারা কী প্রচার করছে।
ক্রিপ্টো ও টোকেনের জগতে অনিয়ন্ত্রিত দৌড়
২০২১-২২ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের ২০টির মধ্যে ১৯টি ক্লাব অন্তত এক ধরনের ক্রিপ্টো পণ্য সমর্থকদের সামনে তুলে ধরে। বহু ক্লাব স্টার্টআপের সঙ্গে নন-ফাঞ্জিবল টোকেন (এনএফটি / NFT) বানায় ‘সংগ্রহযোগ্য’ দাবিতে। উদ্দেশ্য ছিল তরুণ পুরুষ দর্শকের কাছে দ্রুত পৌঁছানো—এই গোষ্ঠী আর্থিক ঝুঁকি নেওয়ায় তুলনামূলক আগ্রহী। অল্প সময়েই দামের ধস নামে (পরে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও) প্রথম ধাক্কায় বহু সমর্থক ক্ষতিগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত হয়।
সমর্থকদের হতাশা ও ক্ষোভ
লেখক যে সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের কেউ ক্ষুব্ধ—নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা না থাকায় তারা নিজ ক্লাবের দ্বারা শোষিত বলে মনে করে। আবার কেউ বিস্মিত কেন ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলে ভাবা খেলোয়াড়রা এমন ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের পক্ষে মুখ খুলেছেন। আস্থা ও আনুগত্যের সম্পর্ক আর্থিক পরীক্ষাগারে রূপ নেওয়ায় আবেগে আঘাত লাগে।
নৈতিক প্রশ্ন ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
কিছু সমর্থক সরাসরি স্পন্সরের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়। চলতি বছর আর্সেনাল সমর্থকদের একাংশ রুয়ান্ডার পর্যটন বোর্ডের চুক্তি বাতিলের দাবি তোলে—পাশবর্তী কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে সরকার-সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভিযানের পর। পরবর্তীতে দুদেশ একটি নড়বড়ে সমঝোতায় গেলেও বিতর্ক দমেনি। অধিকাংশ সমর্থক ভূ-রাজনৈতিক জটিলতায় জড়াতে চায় না; তবু বারবার ঘটনাগুলো দেখিয়ে দ’উরসো বলেন—যখন প্রচারণা ও ইমেজ বিনিয়োগের লক্ষ্য হয়, মাঠে ভূ-রাজনীতি ঢুকবেই।
পরিচালনাহীন বাণিজ্যিকীকরণের ঝুঁকি
লেখকের যুক্তি—ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অর্থ আনার কৌশলে পারদর্শী হলেও ‘কোন অর্থ’ এবং ‘কোন শর্তে’ তা প্রবেশ করছে—এই অভিভাবকত্বে ব্যর্থ। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া প্ল্যাটফর্ম, অস্পষ্ট মালিকানার প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্র্যান্ড ও উচ্চ ঝুঁকির আর্থিক পণ্য একই দরজায় ঢুকে সমর্থকের আস্থাকে ব্যবহার করছে।
উপসংহার: শার্টের সামনে লেখা ভবিষ্যতের সংকেত
একটি জার্সি এখন স্থানীয় ভোক্তা পণ্যের বিজ্ঞাপন নয়—এটি বিশ্বশক্তির প্রভাব, শক্তি নিরাপত্তা, আর্থিক উদ্ভাবনার ঝুঁকি, এমনকি মানবাধিকার ও সংঘাতের প্রতিধ্বনি বহন করে। সামনের অংশে কোন নাম উঠছে, সেটি ক্লাবের খেলাধুলার সাফল্যের মতোই অর্থনৈতিক নীতি ও নৈতিক অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। ফুটবল যদি নিজের বিশ্বাসযোগ্য ভবিষ্যৎ চায়, তবে কেবল আয়ের অঙ্ক নয়—স্বচ্ছতা, যাচাই ও সমর্থক সুরক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।