০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫

ফরিদপুরের মুড়ি: ঐতিহ্যের খাস প্রসাদ ও বিশেষ চালের গল্প

ফরিদপুর: মুড়ির স্বাদে ও গন্ধে এক অনন্য জেলা

ফরিদপুর জেলা শুধু রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক কিংবা পুডিং চালের জন্যই বিখ্যাত নয়—এই জেলার আরেকটি অমূল্য খাদ্য ঐতিহ্য হলো মুড়ি। মুড়ি বা খই বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হলেও ফরিদপুরের মুড়ির স্বাদ ও গন্ধ এককথায় অতুলনীয়। এখানকার মাটি, পানি, চালের ধরন ও প্রাচীন প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে ফরিদপুরের মুড়িকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, ফরিদপুরের মুড়ির কদর রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকি দেশের বাইরেও প্রবাসীদের কাছে এটি এক স্মৃতিমধুর খাবারে পরিণত হয়েছে।

মুড়ি তৈরির চালের বিশেষত্ব

ফরিদপুরে মুড়ি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির চাল। এসব চাল মুড়ি তৈরির জন্য আদর্শ, কারণ এগুলোর দানার গঠন, আর্দ্রতা ও স্টার্চের গুণগত মান খুবই উপযুক্ত। সবচেয়ে প্রচলিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

কালা জয়না – এটি ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি চাল। ছোট দানা, স্বল্প আর্দ্রতা এবং বিশেষ স্বাদের কারণে মুড়ি তৈরিতে খুবই জনপ্রিয়।

কদর থাকলেও হারিয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি

সাদামতো জয়না বা জয়না সাদা – কালা জয়নাসদৃশ, তবে সাদা রঙের দানা। ফরিদপুরের চরাঞ্চলে বেশি জন্মে।

চিকন স্বর্ণা – মূলত ফরিদপুরের সদর, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা এলাকায় এর উৎপাদন বেশি। এই চাল থেকে চিকন ও ঝরঝরে মুড়ি হয়।

বাদামি চাল (মটর চাল) – কিছু অঞ্চলে মিশ্রিত চাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এতে মুড়ি তুলনামূলকভাবে হালকা ও খাসখাসে হয়।

বিরল জাতের দেশীয় চাল – ফরিদপুরের কিছু পুরোনো খাল ও নদীবিধৌত এলাকার কৃষকরা আজও ব্যবহার করেন স্থানীয় জাতের চাল, যা মুড়ির জন্য প্রাকৃতিকভাবে উপযোগী।

এই চালগুলোর উৎপাদনে সাধারণত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার হয়, ফলে এসব চাল থেকে তৈরি মুড়ির স্বাদ হয় প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত।

মুড়ি তৈরির প্রক্রিয়া: হাতে গড়া ঐতিহ্য

ফরিদপুরের মুড়ি তৈরির প্রক্রিয়াটি আজও মূলত হাতে গড়া ও প্রাচীন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। প্রথমে চাল ভিজিয়ে শুকানো হয়। এরপর একটি বিশেষ মাটির হাঁড়িতে (যাকে স্থানীয়ভাবে ‘চুলা হাঁড়ি’ বলা হয়) বালু দিয়ে উচ্চ তাপে গরম করা হয়। সেই গরম বালুর মধ্যে শুকনো চাল দিয়ে দ্রুত নেড়ে তৈরি করা হয় সাদা, ফুলে ওঠা মুড়ি।

এই প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সময়জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য ভুল হলেই মুড়ি পুড়ে যেতে পারে বা কাঠিন্য থেকে যায়। ফরিদপুরের মুড়ি প্রস্তুতকারকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কৌশল শিখে আসছেন।

মুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অর্থনীতি

ফরিদপুরের মুড়ি শুধু একটি খাদ্য নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। জেলার সদর, ভাঙ্গা, বোয়ালমারী, নগরকান্দা, চরভদ্রাসন ও সদরপুর এলাকায় মুড়ি উৎপাদন হয় ব্যাপক হারে। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এই মুড়ি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয়। বহু পরিবার এই মুড়ি উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে ফরিদপুরের মুড়ি প্যাকেটজাত করেও বাজারে আসছে। কিছু ব্র্যান্ড ইতোমধ্যেই ‘ফরিদপুরের মুড়ি’ নামে দেশের বিভিন্ন সুপারশপে জায়গা করে নিয়েছে।

আধুনিকতা ও চ্যালেঞ্জ

যদিও ফরিদপুরের মুড়ির চাহিদা দিনদিন বাড়ছে, তবে চাষাবাদে নতুন জাতের আধিপত্য, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দক্ষ শ্রমিকের সংকটের কারণে মুড়ির উৎপাদন কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া অনেক কৃষক এখন উচ্চ ফলনশীল জাতের দিকে ঝুঁকছেন, যা মুড়ি তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়।

মেশিনে মুড়ি, অস্তিত্ব সংকটে হাতে তৈরিকারকরা | The Daily Star Bangla

স্বাদবাহী সংস্কৃতি

ফরিদপুরের মুড়ি একাধারে একটি ঐতিহ্য, একটি অর্থনীতি এবং একটি স্বাদবাহী সংস্কৃতি। এই মুড়ির পেছনে রয়েছে বিশেষ চালের বৈচিত্র্য, প্রাচীন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ও মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। বর্তমান প্রজন্মের উচিত এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, গবেষণা করা এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফরিদপুরের মুড়িকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করা।

এই মুড়ি শুধু একটি খাবার নয়, বরং ফরিদপুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক সুগন্ধময় অধ্যায়।

ফরিদপুরের মুড়ি: ঐতিহ্যের খাস প্রসাদ ও বিশেষ চালের গল্প

০৫:৫৭:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫

ফরিদপুর: মুড়ির স্বাদে ও গন্ধে এক অনন্য জেলা

ফরিদপুর জেলা শুধু রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক কিংবা পুডিং চালের জন্যই বিখ্যাত নয়—এই জেলার আরেকটি অমূল্য খাদ্য ঐতিহ্য হলো মুড়ি। মুড়ি বা খই বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হলেও ফরিদপুরের মুড়ির স্বাদ ও গন্ধ এককথায় অতুলনীয়। এখানকার মাটি, পানি, চালের ধরন ও প্রাচীন প্রক্রিয়া—সব মিলিয়ে ফরিদপুরের মুড়িকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, ফরিদপুরের মুড়ির কদর রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকি দেশের বাইরেও প্রবাসীদের কাছে এটি এক স্মৃতিমধুর খাবারে পরিণত হয়েছে।

মুড়ি তৈরির চালের বিশেষত্ব

ফরিদপুরে মুড়ি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির চাল। এসব চাল মুড়ি তৈরির জন্য আদর্শ, কারণ এগুলোর দানার গঠন, আর্দ্রতা ও স্টার্চের গুণগত মান খুবই উপযুক্ত। সবচেয়ে প্রচলিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে:

কালা জয়না – এটি ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি চাল। ছোট দানা, স্বল্প আর্দ্রতা এবং বিশেষ স্বাদের কারণে মুড়ি তৈরিতে খুবই জনপ্রিয়।

কদর থাকলেও হারিয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি

সাদামতো জয়না বা জয়না সাদা – কালা জয়নাসদৃশ, তবে সাদা রঙের দানা। ফরিদপুরের চরাঞ্চলে বেশি জন্মে।

চিকন স্বর্ণা – মূলত ফরিদপুরের সদর, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা এলাকায় এর উৎপাদন বেশি। এই চাল থেকে চিকন ও ঝরঝরে মুড়ি হয়।

বাদামি চাল (মটর চাল) – কিছু অঞ্চলে মিশ্রিত চাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এতে মুড়ি তুলনামূলকভাবে হালকা ও খাসখাসে হয়।

বিরল জাতের দেশীয় চাল – ফরিদপুরের কিছু পুরোনো খাল ও নদীবিধৌত এলাকার কৃষকরা আজও ব্যবহার করেন স্থানীয় জাতের চাল, যা মুড়ির জন্য প্রাকৃতিকভাবে উপযোগী।

এই চালগুলোর উৎপাদনে সাধারণত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার হয়, ফলে এসব চাল থেকে তৈরি মুড়ির স্বাদ হয় প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত।

মুড়ি তৈরির প্রক্রিয়া: হাতে গড়া ঐতিহ্য

ফরিদপুরের মুড়ি তৈরির প্রক্রিয়াটি আজও মূলত হাতে গড়া ও প্রাচীন পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। প্রথমে চাল ভিজিয়ে শুকানো হয়। এরপর একটি বিশেষ মাটির হাঁড়িতে (যাকে স্থানীয়ভাবে ‘চুলা হাঁড়ি’ বলা হয়) বালু দিয়ে উচ্চ তাপে গরম করা হয়। সেই গরম বালুর মধ্যে শুকনো চাল দিয়ে দ্রুত নেড়ে তৈরি করা হয় সাদা, ফুলে ওঠা মুড়ি।

এই প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সময়জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য ভুল হলেই মুড়ি পুড়ে যেতে পারে বা কাঠিন্য থেকে যায়। ফরিদপুরের মুড়ি প্রস্তুতকারকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কৌশল শিখে আসছেন।

মুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অর্থনীতি

ফরিদপুরের মুড়ি শুধু একটি খাদ্য নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। জেলার সদর, ভাঙ্গা, বোয়ালমারী, নগরকান্দা, চরভদ্রাসন ও সদরপুর এলাকায় মুড়ি উৎপাদন হয় ব্যাপক হারে। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এই মুড়ি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয়। বহু পরিবার এই মুড়ি উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে ফরিদপুরের মুড়ি প্যাকেটজাত করেও বাজারে আসছে। কিছু ব্র্যান্ড ইতোমধ্যেই ‘ফরিদপুরের মুড়ি’ নামে দেশের বিভিন্ন সুপারশপে জায়গা করে নিয়েছে।

আধুনিকতা ও চ্যালেঞ্জ

যদিও ফরিদপুরের মুড়ির চাহিদা দিনদিন বাড়ছে, তবে চাষাবাদে নতুন জাতের আধিপত্য, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দক্ষ শ্রমিকের সংকটের কারণে মুড়ির উৎপাদন কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া অনেক কৃষক এখন উচ্চ ফলনশীল জাতের দিকে ঝুঁকছেন, যা মুড়ি তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়।

মেশিনে মুড়ি, অস্তিত্ব সংকটে হাতে তৈরিকারকরা | The Daily Star Bangla

স্বাদবাহী সংস্কৃতি

ফরিদপুরের মুড়ি একাধারে একটি ঐতিহ্য, একটি অর্থনীতি এবং একটি স্বাদবাহী সংস্কৃতি। এই মুড়ির পেছনে রয়েছে বিশেষ চালের বৈচিত্র্য, প্রাচীন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ও মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম। বর্তমান প্রজন্মের উচিত এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, গবেষণা করা এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফরিদপুরের মুড়িকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করা।

এই মুড়ি শুধু একটি খাবার নয়, বরং ফরিদপুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক সুগন্ধময় অধ্যায়।