বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র মহাসচিব সম্প্রতি একটি খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশে চরম ডানপন্থী শক্তির উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে এবং এটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলের অবসানের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার সুযোগ নিচ্ছে কিছু রক্ষণশীল ও ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠী—যারা গণতন্ত্র, উদারতা ও বহুত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হুমকি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক শূন্যতায় নতুন খেলোয়াড়ের উত্থান
বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনৈতিক পরিকাঠামো দুর্বল হলে বিভিন্ন মৌলবাদী বা চরমপন্থী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। সেই কাঠামো ভেঙে পড়ার পর নতুন বিকল্প শক্তি হিসেবে কেউ সুসংগঠিত না হওয়ায় কিছু উগ্র গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
ডান চরমপন্থার এই উত্থান কেন?
১. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান:
যেসব ইসলামপন্থী গোষ্ঠী আগে নিষ্ক্রিয় বা সরকার দ্বারা দমন হয়েছিল, তারা আবার মাঠে সক্রিয় হচ্ছে। হেফাজত থেকে শুরু করে মাদ্রাসাভিত্তিক ছোট ছোট সংগঠনও এখন রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে চাচ্ছে।
২. তরুণদের হতাশা ও অনিশ্চয়তা:
রাজনৈতিক সংস্কারে অগ্রগতি না হওয়ায় এবং তরুণদের মধ্যে কর্মসংস্থান সংকট থাকায় অনেকেই বেসামরিক বা ধর্মভিত্তিক আদর্শে দিকচ্যুত হচ্ছে। সামাজিক মিডিয়ায় ‘নৈতিকতা রক্ষা’ বা ‘ইসলামি সংস্কৃতি রক্ষা’ নামে প্রচার চালিয়ে এসব গোষ্ঠী নতুন সমর্থন আদায় করছে।
৩. উদারপন্থী নেতৃত্বের দুর্বলতা:
বিএনপি বা অন্যান্য মধ্যপন্থী শক্তি এখনো সুসংগঠিত হতে পারেনি। নির্বাচন, আন্দোলন কিংবা রাজনৈতিক পুনঃসংযোগের মতো বড় কোনো কৌশল এখনও দৃশ্যমান নয়। এই অনিশ্চয়তায় রক্ষণশীল গোষ্ঠী সুবিধা নিচ্ছে।
বিএনপির অবস্থান ও উদ্বেগ
সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছু অতি রক্ষণশীল শক্তি এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। এদের উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক নয়। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তারা নতুন করে সাহস পেয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ফিরিয়ে আনতে হলে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং ভোটের মাধ্যমে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের পথ তৈরি করতে হবে।”
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে: বিপদের সম্ভাবনা
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সামির হাসান বলেন, “চরম ডানপন্থা সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যদি এই গোষ্ঠীগুলোর আদর্শ জনপ্রিয়তা পায়, তবে ভবিষ্যতে নারী অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।”
তিনি বলেন, “শুধু ধর্ম নয়, কিছু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীও এখন রাজনৈতিক মাঠে তৎপর হচ্ছে—যারা বিদেশবিরোধী প্রচারে, আঞ্চলিক বিভাজনে এবং বহির্বিশ্বের প্রতি চরম সন্দেহে পরিচালিত হচ্ছে। এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা।”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
ঢাকার মিরপুরের এক ব্যবসায়ী বলেন, “আগে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এখন দেখছি, কেউ কেউ ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। এটা ভয় পাই।”
চট্টগ্রামের এক কলেজছাত্রী বলেন, “ফেসবুকে এমন অনেক পোস্ট দেখি, যেখানে নারীদের স্বাধীনতা বা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে লক্ষ্য করা হয়। এসব দেখে ভয় হয় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে।”
উপসংহার: কোন পথে বাংলাদেশের রাজনীতি?
যদি রাজনৈতিক শক্তিগুলো দ্রুত সংগঠিত না হয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম ডানপন্থীদের প্রভাব আরও গভীর হতে পারে। বিএনপি যেমন আশঙ্কা করছে, তেমনি দেশের প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীও উদ্বিগ্ন—বাংলাদেশ কি ফের একবার ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের নামে সংকীর্ণ রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে?
নতুন নেতৃত্ব, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গঠনের মাধ্যমেই এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। তা না হলে রাজনীতির ভারসাম্য চরমভাবে বদলে যেতে পারে।
এই সংস্করণটি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত। আপনি চাইলে এটি এখনই পত্রিকায় বা অনলাইনে ব্যবহার করতে পারেন।