০৪:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫

আয়ুব বাচ্চু: বাংলাদেশের রক সংগীতের পথিকৃৎ

জন্ম ও শৈশব

আয়ুব বাচ্চু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬ আগস্ট ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। তার পুরো নাম ছিল আয়ুব বাচ্চু চৌধুরী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তার গভীর টান ছিল, যদিও পরিবারে কেউ সংগীতশিল্পী ছিলেন না। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গিটার শিখতে শুরু করেন। আশেপাশের মানুষ তখনই বুঝতে পেরেছিল, এই ছেলেটি একদিন বড় কিছু করবে।

সংগীত জগতে আগমন

আয়ুব বাচ্চুর সংগীতজীবনের সূচনা হয় ১৯৭৭ সালে, যখন তিনি ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ডে গিটারবাদক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’-এ যোগ দেন। সোলসে তিনি প্রায় ১০ বছর ছিলেন, যেখানে তিনি গিটার বাজানোর পাশাপাশি কিছু গানে কণ্ঠও দিয়েছেন। এই সময়ে তিনি নিজেকে একজন দক্ষ গিটারবাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

আইয়ুব বাচ্চুকে হারানোর ৬ বছর

এলআরবির জন্ম ও নতুন ধারার সূচনা

১৯৯১ সালে আয়ুব বাচ্চু ‘সোলস’ ছেড়ে দিয়ে নিজেই গঠন করেন ‘এলআরবি’ (Love Runs Blind)। এই ব্যান্ডের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে নতুন এক সংগীতধারা চালু করেন—হার্ড রক ও ব্লুজ রক। বাংলাদেশের সংগীতজগতে যেখানে পপ ও লোকসংগীতই ছিল মূলধারা, সেখানে আয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি প্রথমবারের মতো গিটার সলো, রক রিফ ও পাশ্চাত্য রক ঘরানার গান দেশের শ্রোতাদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলেন।

‘চলো বদলে যাই’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘রুপালি গিটার’, ‘শেষ চিঠি’—এই গানগুলো শুধু ব্যান্ড সংগীতকেই নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের সংগীতধারাকেই নতুন মাত্রা দিয়েছে। আয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠের জাদু, গিটারের কারিশমা ও গভীর দার্শনিক কথামালার সংমিশ্রণ তাকে গড়ে তোলে এক ব্যতিক্রমী শিল্পী হিসেবে।

গিটারবাদনে অগ্রগণ্য

আয়ুব বাচ্চু ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা গিটারবাদক। তিনি তার জীবনভর গিটারের প্রেমে ছিলেন। ফেন্ডার স্ট্রাটোকাস্টার, গিবসন লেস পল, ইব্যানেজসহ নানা ধরনের গিটার নিয়ে তিনি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। রক, ব্লুজ, জ্যাজ, ক্লাসিকাল—প্রত্যেকটি ধারার উপরেই তার ছিল পারদর্শিতা।

Bengali rock singer Ayub Bachchu passes away

তিনি অনেক তরুণ গিটারবাদকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। গিটার বাজানোর শিক্ষায়, সাউন্ড সেটআপে ও অনুশীলন পদ্ধতিতে তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।

চলচ্চিত্র ও একক অ্যালবাম

আয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড সংগীতের পাশাপাশি একক অ্যালবামও প্রকাশ করেছেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’ প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। এরপর ‘ময়না’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘জীবনের গল্প’সহ অনেক জনপ্রিয় অ্যালবাম বের হয়। চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি কিছু গান করেছেন, যদিও তার মূল আকর্ষণ ছিল ব্যান্ড সংগীতেই।

ব্যক্তিজীবন ও মৃত্যু

আয়ুব বাচ্চু ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সহজ-সরল, বন্ধুপ্রিয় ও নিরহংকারী। তিনি নতুন শিল্পীদের সহযোগিতা করতেন এবং সংগীতের প্রচার ও প্রসারে সর্বদা ভূমিকা রাখতেন।

আইয়ুব বাচ্চু'র স্বপ্নটাই আরো বড় পরিসরে...

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার আকস্মিক প্রয়াণের ফলে দেশের সংগীতজগতে গভীর শোক নেমে আসে। কোটি ভক্ত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটে।

উত্তরাধিকার

আয়ুব বাচ্চু শুধু একজন রকস্টার ছিলেন না, ছিলেন সংগীতের এক জীবন্ত প্রবাহ। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে আধুনিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান অতুলনীয়। তিনি নতুন প্রজন্মকে গান লিখতে, গাইতে ও বাজাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার রেখে যাওয়া গান, গিটার রিফ, কণ্ঠ ও দর্শন আজও বাংলাদেশি তরুণদের অনুপ্রেরণা যোগায়।

‘রুপালি গিটার’ এখন আর শুধুই একটি গান নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক আত্মিক স্মারক, যেখানে আয়ুব বাচ্চুর সুর আর কণ্ঠ চিরকাল বেঁচে থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

আয়ুব বাচ্চু: বাংলাদেশের রক সংগীতের পথিকৃৎ

০৬:০৯:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

জন্ম ও শৈশব

আয়ুব বাচ্চু জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬ আগস্ট ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। তার পুরো নাম ছিল আয়ুব বাচ্চু চৌধুরী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ও সৃষ্টিশীল। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি তার গভীর টান ছিল, যদিও পরিবারে কেউ সংগীতশিল্পী ছিলেন না। স্কুলজীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গিটার শিখতে শুরু করেন। আশেপাশের মানুষ তখনই বুঝতে পেরেছিল, এই ছেলেটি একদিন বড় কিছু করবে।

সংগীত জগতে আগমন

আয়ুব বাচ্চুর সংগীতজীবনের সূচনা হয় ১৯৭৭ সালে, যখন তিনি ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ডে গিটারবাদক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’-এ যোগ দেন। সোলসে তিনি প্রায় ১০ বছর ছিলেন, যেখানে তিনি গিটার বাজানোর পাশাপাশি কিছু গানে কণ্ঠও দিয়েছেন। এই সময়ে তিনি নিজেকে একজন দক্ষ গিটারবাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

আইয়ুব বাচ্চুকে হারানোর ৬ বছর

এলআরবির জন্ম ও নতুন ধারার সূচনা

১৯৯১ সালে আয়ুব বাচ্চু ‘সোলস’ ছেড়ে দিয়ে নিজেই গঠন করেন ‘এলআরবি’ (Love Runs Blind)। এই ব্যান্ডের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে নতুন এক সংগীতধারা চালু করেন—হার্ড রক ও ব্লুজ রক। বাংলাদেশের সংগীতজগতে যেখানে পপ ও লোকসংগীতই ছিল মূলধারা, সেখানে আয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি প্রথমবারের মতো গিটার সলো, রক রিফ ও পাশ্চাত্য রক ঘরানার গান দেশের শ্রোতাদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলেন।

‘চলো বদলে যাই’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘রুপালি গিটার’, ‘শেষ চিঠি’—এই গানগুলো শুধু ব্যান্ড সংগীতকেই নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের সংগীতধারাকেই নতুন মাত্রা দিয়েছে। আয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠের জাদু, গিটারের কারিশমা ও গভীর দার্শনিক কথামালার সংমিশ্রণ তাকে গড়ে তোলে এক ব্যতিক্রমী শিল্পী হিসেবে।

গিটারবাদনে অগ্রগণ্য

আয়ুব বাচ্চু ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা গিটারবাদক। তিনি তার জীবনভর গিটারের প্রেমে ছিলেন। ফেন্ডার স্ট্রাটোকাস্টার, গিবসন লেস পল, ইব্যানেজসহ নানা ধরনের গিটার নিয়ে তিনি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। রক, ব্লুজ, জ্যাজ, ক্লাসিকাল—প্রত্যেকটি ধারার উপরেই তার ছিল পারদর্শিতা।

Bengali rock singer Ayub Bachchu passes away

তিনি অনেক তরুণ গিটারবাদকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন। গিটার বাজানোর শিক্ষায়, সাউন্ড সেটআপে ও অনুশীলন পদ্ধতিতে তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।

চলচ্চিত্র ও একক অ্যালবাম

আয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড সংগীতের পাশাপাশি একক অ্যালবামও প্রকাশ করেছেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’ প্রকাশ পায় ১৯৮৬ সালে। এরপর ‘ময়না’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘জীবনের গল্প’সহ অনেক জনপ্রিয় অ্যালবাম বের হয়। চলচ্চিত্রের জন্যও তিনি কিছু গান করেছেন, যদিও তার মূল আকর্ষণ ছিল ব্যান্ড সংগীতেই।

ব্যক্তিজীবন ও মৃত্যু

আয়ুব বাচ্চু ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সহজ-সরল, বন্ধুপ্রিয় ও নিরহংকারী। তিনি নতুন শিল্পীদের সহযোগিতা করতেন এবং সংগীতের প্রচার ও প্রসারে সর্বদা ভূমিকা রাখতেন।

আইয়ুব বাচ্চু'র স্বপ্নটাই আরো বড় পরিসরে...

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার আকস্মিক প্রয়াণের ফলে দেশের সংগীতজগতে গভীর শোক নেমে আসে। কোটি ভক্ত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটে।

উত্তরাধিকার

আয়ুব বাচ্চু শুধু একজন রকস্টার ছিলেন না, ছিলেন সংগীতের এক জীবন্ত প্রবাহ। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে আধুনিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান অতুলনীয়। তিনি নতুন প্রজন্মকে গান লিখতে, গাইতে ও বাজাতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার রেখে যাওয়া গান, গিটার রিফ, কণ্ঠ ও দর্শন আজও বাংলাদেশি তরুণদের অনুপ্রেরণা যোগায়।

‘রুপালি গিটার’ এখন আর শুধুই একটি গান নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক আত্মিক স্মারক, যেখানে আয়ুব বাচ্চুর সুর আর কণ্ঠ চিরকাল বেঁচে থাকবে।