যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বিশ্বের বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে আরও বেশ কিছু দেশকে আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করলেন, তখন সেই সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে শেয়ার বাজারে তীব্র প্ররোচনা হিসেবে কাজ করে। সুইজারল্যান্ড, ভারত, কানাডা, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ এই শুল্কের ফলে চাপের মুখে পড়ে গেছে এবং কয়েকটি দেশে বৈঠকে মীমাংসার চেষ্টা শুরু হয়েছে। একই সময় দুর্বল শ্রমবাজার এবং সেই সংক্রান্ত উদ্বেগজনক তথ্যসহ শাসনক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়াও হালচালকে আরও অস্থিতিশীল করেছে।
বিশ্ববাজারে প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের নতুন শুল্কের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রধান স্টক সূচকগুলোতে তীব্র পতন দেখা গেছে। ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ১.২৩ শতাংশ কমে ৪৩,৫৮৮.৫৮ পয়েন্টে বন্ধ হয়েছে, এস অ্যান্ড পি ৫০০ প্রায় ১.৬ শতাংশ খোয়াচ্ছে, আর নাসডাক কম্পোজিট ২.২৪ শতাংশ পড়ে গেছে। ইউরোপের STOXX 600 সূচক একদিনেই ১.৮৯ শতাংশ নেমে গিয়েছে।
এই বাজারগুলো তীব্র আঘাত পেয়েছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে জুলাই মাসের চাকরি বৃদ্ধির তথ্য প্রত্যাশিতের তুলনায় কম ছিল এবং আগের মাসের তথ্যও পুনর্বিবেচনায় নিচে নামিয়ে আনা হয়েছিল, যা শ্রমবাজারের ধীরগতি নির্দেশ করছে। সেই রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প শ্রম পরিসংখ্যান বিভাগের কমিশনার এরিকা ম্যাকএন্টারফারকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন এবং কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন যে চাকরির ডেটা “ম্যানিপুলেট” করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিরক্ষা ও নীতি
প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কেউ জানান যে শুল্ককে ঘিরে তৈরি অনিশ্চয়তা এমন এক চাপ তৈরি করেছে যা ট্রাম্পকে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি গড়ার ক্ষেত্রে কথোপকথন চালাতে সহায়তা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা সম্প্রতি ট্রাম্পের সঙ্গে একটি কাঠামোগত আলোচনা শুরু করেছে, এখনও গাড়ি ও বিমান সংক্রান্ত সুবিধাসহ সম্মত অনুচ্ছেদগুলো কার্যকর করার জন্য আরও নির্বাহী আদেশ প্রত্যাশা করছে।
ট্রান্সশিপমেন্ট সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কীভাবে সংজ্ঞায়িত ও প্রয়োগ করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সেই নীতিতে এমন একটি ধারাও আছে যেখানে যদি কোনো রপ্তানিকর্তা উচ্চ শুল্কযুক্ত উৎস থেকে আসা পণ্যের আসল উৎস লুকাতে চেষ্টা করে, তাহলে তার উপর অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হতে পারে।
মূল্যের ঊর্ধ্বগতি
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে দামের উর্ধ্বগতি প্রথম লক্ষণ হিসেবে এসে পড়েছে। মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের তথ্যমতে, জুনে বাড়ির আসবাবপত্র ও টেকসই গৃহস্থালী উপকরণের মূল্য ১.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা মার্চ ২০২২ সালের পর সর্ববৃহৎ বার্ষিক বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
জয়ের কেউ নেই
উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে প্রভাবিত অনেক দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমানোর চেষ্টা করছে। সুইজারল্যান্ড জানিয়েছে যে তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজবে, কারণ এই সিদ্ধান্ত তাদের রপ্তানি খাত ও পুরো অর্থনীতি নিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক প্রকৌশল শিল্পের প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে তারা সত্যিই হতবাক।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য মন্ত্রী পার্কস টাউ জানিয়েছেন যে তারা দেশের কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি রক্ষায় বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে, কারণ তাদের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়েছে।
অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সহজ শুল্ক হ্রাস তাদের মাঝে কিছু স্বস্তি দিয়েছে, কারণ তাদের রপ্তানি যেখানে শুরুতে উচ্চ শুল্কের সম্ভাবনাময় হুমকির মুখে পড়ছিল, সেখানে হঠাৎ করে কম আঘাত পেয়ে তুলনামূলক ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হয়েছে। থাইল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ৩৬ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে নামানোর সিদ্ধান্ত তাদের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সহায়তা করবে, যা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আয়ের নতুন সুযোগ তৈরি করবে।
অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ট্রাম্প তাদের জন্য ন্যূনতম শুল্ক হার ১০ শতাংশ রেখেছেন, যার ফলে তাদের পণ্যগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে এবং রপ্তানি বাড়াতে সহায়তা পাবে।
বিশ্লেষকরা সমালোচনা করছেন
বизнес ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক নয়। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক ভিপি ব্যাংকের এশিয়া সিও এবং কো-হেড থমাস রুফ বলেছেন, বাণিজ্য সংঘাতে প্রকৃত কোনো জয়ী নেই; কিছু দেশ ভালো শর্ত পেলেও সামগ্রিক প্রভাব নেতিবাচক হচ্ছে। জার্মানির মোসেল উপত্যকায় পরামর্শদাতা জোহানেস সেলবাখ বলেছেন, এই শুল্কগুলো আমেরিকানদেরকেও ব্যথা দিচ্ছে, আমাদেরকেও, ফলে আটলান্টিকের উভয় পাড়ে চাকরি ও মুনাফা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কয়েকটি ইউরোপীয় ফ্যাশন ও প্রসাধনী কোম্পানি, যেমন লোরিয়াল, এখন শুল্কের প্রভাব কমাতে “ফার্স্ট সেল” নীতি পরীক্ষা করছে। এই পুরনো আমেরিকার শুল্ক কাঠামোর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো কারখানা থেকে পণ্য বের হওয়ার সময় তার মূল্যের সঙ্গে তুলনায় কম শুল্ক প্রদানের সুযোগ খুঁজছে।
কানাডা ও ভারতের পরিস্থিতি
ট্রাম্প জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে বিদেশি নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন এবং গত এপ্রিল মাসে যখন শুল্ক নীতিগুলো প্রথমবার ঘোষিত হয়েছিল তখন থেকেই বাজারে বিক্রয়চাপ তৈরি হয়। তাঁর আদেশ অনুযায়ী, কিছু দেশ আলোচনায় থাকলেও এমন শর্ত উত্থাপন করেছে যা তাঁর দৃষ্টিতে আমেরিকা ও তাদের বাণিজ্য সম্পর্কের ভারসাম্য ঠিকমতো বজায় রাখছে না বা অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত সমন্বয় করেনি।
কানাডার জন্য একটি পৃথক আদেশ জারি করে ফেন্টানাইলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপরের শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে, কারণ ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন যে কানাডা অবৈধ মাদক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে “পর্যাপ্ত সহায়তা” দেয়নি। অন্যদিকে অনেক পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের সময় মেক্সিকোকে ৩০ শতাংশ শুল্ক থেকে ৯০ দিনের ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বৃহত্তর বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনায় এগিয়ে যাওয়া যায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এই সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন এবং কানাডীয় চাকরি রক্ষা ও রপ্তানি বৈচিত্র্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনায় এখন স্থিতি বিরাজ করছে, কারণ ওয়াশিংটন নিউ দিল্লির রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি শাসনবিরুদ্ধ সূত্র জানিয়েছে, এই শুল্ক আলোচনার প্রেক্ষাপটে এসেছে এবং এতে ভারতীয় রপ্তানির ওপর চাপ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক নীতি বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে, এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে স্পষ্ট কোনো বিজয়ী চিহ্নিত করা কঠিন। অনেক দেশ নতুন সমঝোতা খোঁজার চেষ্টা করছে, আবার অনেকে নিজেদের প্রতিরক্ষা কৌশল গড়ে তুলছে। এই সিদ্ধান্তগুলোর ধারাবাহিক প্রভাব বৈশ্বিক বাণিজ্য, বাজার মূল্য, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে প্রতিফলিত হবে।