২০২৫ সালটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণ। কোভিড-১৯ মহামারির পাঁচ বছর পর আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০-এর মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ পৃথিবীর বহু দেশ এখনো জলবায়ু পরিবর্তন, উচ্চ খাদ্যমূল্য ও সংঘাতজনিত পুনঃপুন সংকটে বিপর্যস্ত। এসব ঝড়ে পুষ্টিকর খাদ্যের ধারা বাধাগ্রস্ত হয়ে বৈশ্বিক ক্ষুধা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার গুরুতর চিত্র
১. বিশ্বব্যাপী অপুষ্টির ঊর্ধ্বগতি
২০২৩ সালে সারা বিশ্বে ৭৩৩ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টিতে ভুগেছে—২০১৯-এর তুলনায় ১৫২ মিলিয়ন বেশি। এ প্রবণতা দেখাচ্ছে, ক্ষুধা সংকট দ্রুত গভীর হচ্ছে।
২. লুকানো ক্ষুধা: স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সামর্থ্যহীন ২.৮ বিলিয়ন মানুষ
বর্ধিত খাদ্যমূল্য ও আয়-বৈষম্যের কারণে ২০২২ সালে ২.৮ বিলিয়ন মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য কিনতে পারেনি। ফলে শরীরে ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি দেখা দিলেও তা বহুলাংশে অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।

৩. খাদ্যমূল্য ও চরম দারিদ্র্য
বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য মাত্র ১ শতাংশ বাড়লেই আরও ১ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের ধারায় পড়ে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামান্য দোলাচলই জীবন-জীবিকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
৪. অদক্ষতার গোপন ব্যয়
অক্সফোর্ড ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা প্রতি বছর ১০ ট্রিলিয়ন ডলার অনির্দিষ্ট ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—বাজার অকার্যকারিতা, অপচয় ও অসমতা যার মূল কারণ।

৫. হস্তক্ষেপ না হলে ২০৩০-এও ৯৫০ মিলিয়ন মানুষ ঝুঁকিতে
ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি আউটলুক পূর্বাভাস দিচ্ছে, দৃঢ় বিনিয়োগ ও নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া ২০৩০ সালেও ৯৫০ মিলিয়ন মানুষ তীব্র খাদ্য সুরক্ষা ঝুঁকিতে রয়ে যাবে—‘জিরো হাঙ্গার’ লক্ষ্য তখন অধরাই থেকে যাবে।
তথ্যঘাটতি সংকটকে বাড়াচ্ছে
- বিশ্বের অর্ধেকের বেশি খাদ্য-অনিরাপদ মানুষ এমন দেশে বাস করে, যেখানে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর।
- বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ এসডিজি-১ (দারিদ্র্য দূর) ও এসডিজি-২ (ক্ষুধা দূর) অগ্রগতি-সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে রয়েছে।
- ভঙ্গুর ১৮ টি দেশের মধ্যে মাত্র ৪ টিতে জাতীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান আছে।
এই শূন্যতা নীতি নির্ধারণকে কঠিন করে তোলে এবং প্রকৃত ক্ষুধার পরিসরকে আড়ালে রাখে।

ডাটা-উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান
- গ্লোবাল ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি ড্যাশবোর্ড: ৪৫-এর বেশি সূচক একত্রিত করে কোথায় তথ্যঘাটতি আছে তা দেখায়।
- রিয়েল-টাইম বাজারমূল্য নজরদারি: মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে ৩৬ দেশে ২,১০০-এর বেশি বাজারে খাদ্যমূল্য প্রতি মুহূর্তে ট্র্যাক করা হচ্ছে।
- প্রাথমিক সতর্কব্যবস্থা: ইয়েমেনে মাত্র ৬ টি উচ্চ-ঘনত্ব সূচকে ৮০ শতাংশ খাদ্য সংকট আগেই শনাক্ত হয়; সোমালিয়ায় উন্নত মডেল স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ত্বরিত পদক্ষেপে সহায়তা করছে।
সিদ্ধান্তের সময়—সঠিক ডাটা, সঠিক পদক্ষেপ
বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে শক্তিশালী তথ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি-নবীনতায়। বিশ্বব্যাংক অংশীদারদের সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ দেশে দ্রুত, খরচ-সাশ্রয়ী ডাটা-নির্ভর খাদ্যনিরাপত্তা মূল্যায়ন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে কাজ করছে। পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি আউটলুক-এ নতুন সূচক যোগ করে সহায়তার চাহিদা আগেভাগে চিহ্নিত এবং জরুরি অঞ্চলে দ্রুত সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এসব উদ্যোগ টেকসই ফল আনবে কেবল তখনই, যখন প্রাথমিক তথ্যের মান হবে নির্ভরযোগ্য। এখনই বিনিয়োগের সঠিক সময়—তথ্যকে কাজে লাগিয়ে একটি উন্নত, সহনশীল ও খাদ্যনিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















