০৯:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫

চাকরি হারানো মানুষের গল্প: বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তার সংগ্রামের দিনগুলি

হঠাৎ ছেঁটে ফেলা: এক মধ্যবয়সী ব্যাংকারের বেকার জীবনের সূচনা

২০২৫ সালের এপ্রিলে, দেশের একটি নামকরা বেসরকারি ব্যাংকের এক ঘোষণায় চমকে ওঠেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। বয়স ৪৫, ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন ১৮ বছর ধরে। হঠাৎ একদিন অফিসে ডেকে বলা হয়, “ব্যবসায়িক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে আপনার পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।” কোনো পূর্বাভাস ছিল না, ছিল না ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির সময়। চাকরি হারিয়ে রফিক যেন এক মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে যান অজানা অন্ধকারের মুখোমুখি।

পরিবার ও সমাজের চাপে ভেঙে পড়া আত্মবিশ্বাস

রফিকুল ইসলামের পরিবারে স্ত্রী, এক কলেজপড়ুয়া মেয়ে ও স্কুলপড়ুয়া ছেলে। এতদিন যে মানুষটি সবার ভরসা ছিলেন, হঠাৎ করেই তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজ। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা নানা পরামর্শ দেয়—কেউ বলে ব্যবসা করো, কেউ বলে বিদেশ যাও, কেউ আবার দোষ খোঁজে তার ‘আত্মবিশ্বাসের অভাব’-এ। অথচ রফিক জানেন, ব্যাংক ছাঁটাইয়ের পেছনে তার কর্মদক্ষতার কোনো ঘাটতি ছিল না। দায় ছিল কেবল অর্থনৈতিক সংকট ও মুনাফার নামে ছাঁটাইয়ের নির্মম সিদ্ধান্ত।

Job Loss - How to Financially Cope - Prosperwell Financial

চাকরি খোঁজার কঠিন বাস্তবতা

চাকরি হারানোর পর রফিক প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একের পর এক সিভি পাঠান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ৪০-এর কোঠা পার হওয়া একজন কর্মকর্তার জন্য আজকের বাজারে চাকরি পাওয়া যেন মরুভূমিতে পানির খোঁজ। তরুণদের অগ্রাধিকার, বেতন কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, আর বয়সের ঘাড়ে চেপে বসা ‘অপ্রয়োজনীয়’ তকমা—সব মিলিয়ে তার প্রতি মাস কাটে হতাশায়।

সঞ্চয় গলতে শুরু করেছে

চাকরি থাকা অবস্থায় রফিক নিয়মিত সঞ্চয় করতেন। কিন্তু হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়লে সেই সঞ্চয়ই এখন জীবনের মূল সম্বল। বাসাভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনা, বাজার খরচ — সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। তিন মাস না যেতেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হতে শুরু করে। আগে ভাবতেন অবসরের পর সেই টাকা দিয়ে কিছু করবেন, এখন সেই স্বপ্ন কেবলই কুয়াশায় ঢাকা।

মানসিক চাপ থাকলে যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়

মানসিক চাপ ও আত্মসম্মানের লড়াই

রফিক মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। আত্মসম্মান ও বাস্তবতার সংঘাতে দিন কাটে দোটানায়। আগে যে মানুষটি নিজেই ফাইল সই করতেন, এখন তিনি ভরসা রাখেন পরিচিতদের ফোন কলে। পরিবারকে সামলানো, নিজের হতাশাকে লুকানো, এবং একই সঙ্গে নতুন কোনো সুযোগ খোঁজা — এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে রফিক প্রতিনিয়ত ক্লান্ত।

বিকল্প চিন্তা: ছোট উদ্যোগের স্বপ্ন

চাকরি না পেয়ে রফিক এখন ভাবছেন একটি ছোট ব্যবসা শুরু করার কথা। হয়তো অনলাইনভিত্তিক কিছু, কিংবা একটি ছোট কফির দোকান। তবে, ঝুঁকি, পুঁজি ও স্থায়িত্ব নিয়ে তার মনে দোলাচল রয়েছে। ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য কিছু শুরু করার সাহস পান না, আবার বসে থাকাও সম্ভব নয়।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান প্রেক্ষিত

রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ

রফিকুল ইসলামের মতো শত শত মধ্যবয়সী মানুষ এই মুহূর্তে দেশের নানা প্রান্তে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা মূল্যায়নের বদলে, তারা হয় অবহেলিত, নয় বিস্মৃত। রাষ্ট্রের উচিত, এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা। না হলে, কর্মক্ষম বয়সে তারা হয়ে পড়বেন নিঃস্ব ও অবসাদগ্রস্ত।

হার না মানা মন

সব হতাশার মাঝেও রফিক বলেন, “আমি হার মানিনি। হয়তো আগামীকালই একটা সুযোগ আসবে।” তার এই মনোবলই প্রমাণ করে, সমাজ যদি একটু পাশে দাঁড়ায়, তাহলে অভিজ্ঞ মানুষগুলো নতুন করে গড়ে তুলতে পারেন নিজেদের ভবিষ্যৎ, আর দেশেরও।

চাকরি হারানো মানুষের গল্প: বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তার সংগ্রামের দিনগুলি

০৮:৫৯:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৫

হঠাৎ ছেঁটে ফেলা: এক মধ্যবয়সী ব্যাংকারের বেকার জীবনের সূচনা

২০২৫ সালের এপ্রিলে, দেশের একটি নামকরা বেসরকারি ব্যাংকের এক ঘোষণায় চমকে ওঠেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। বয়স ৪৫, ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন ১৮ বছর ধরে। হঠাৎ একদিন অফিসে ডেকে বলা হয়, “ব্যবসায়িক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে আপনার পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।” কোনো পূর্বাভাস ছিল না, ছিল না ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির সময়। চাকরি হারিয়ে রফিক যেন এক মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে যান অজানা অন্ধকারের মুখোমুখি।

পরিবার ও সমাজের চাপে ভেঙে পড়া আত্মবিশ্বাস

রফিকুল ইসলামের পরিবারে স্ত্রী, এক কলেজপড়ুয়া মেয়ে ও স্কুলপড়ুয়া ছেলে। এতদিন যে মানুষটি সবার ভরসা ছিলেন, হঠাৎ করেই তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজ। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা নানা পরামর্শ দেয়—কেউ বলে ব্যবসা করো, কেউ বলে বিদেশ যাও, কেউ আবার দোষ খোঁজে তার ‘আত্মবিশ্বাসের অভাব’-এ। অথচ রফিক জানেন, ব্যাংক ছাঁটাইয়ের পেছনে তার কর্মদক্ষতার কোনো ঘাটতি ছিল না। দায় ছিল কেবল অর্থনৈতিক সংকট ও মুনাফার নামে ছাঁটাইয়ের নির্মম সিদ্ধান্ত।

Job Loss - How to Financially Cope - Prosperwell Financial

চাকরি খোঁজার কঠিন বাস্তবতা

চাকরি হারানোর পর রফিক প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একের পর এক সিভি পাঠান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ৪০-এর কোঠা পার হওয়া একজন কর্মকর্তার জন্য আজকের বাজারে চাকরি পাওয়া যেন মরুভূমিতে পানির খোঁজ। তরুণদের অগ্রাধিকার, বেতন কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, আর বয়সের ঘাড়ে চেপে বসা ‘অপ্রয়োজনীয়’ তকমা—সব মিলিয়ে তার প্রতি মাস কাটে হতাশায়।

সঞ্চয় গলতে শুরু করেছে

চাকরি থাকা অবস্থায় রফিক নিয়মিত সঞ্চয় করতেন। কিন্তু হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়লে সেই সঞ্চয়ই এখন জীবনের মূল সম্বল। বাসাভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনা, বাজার খরচ — সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়। তিন মাস না যেতেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হতে শুরু করে। আগে ভাবতেন অবসরের পর সেই টাকা দিয়ে কিছু করবেন, এখন সেই স্বপ্ন কেবলই কুয়াশায় ঢাকা।

মানসিক চাপ থাকলে যেসব শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়

মানসিক চাপ ও আত্মসম্মানের লড়াই

রফিক মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। আত্মসম্মান ও বাস্তবতার সংঘাতে দিন কাটে দোটানায়। আগে যে মানুষটি নিজেই ফাইল সই করতেন, এখন তিনি ভরসা রাখেন পরিচিতদের ফোন কলে। পরিবারকে সামলানো, নিজের হতাশাকে লুকানো, এবং একই সঙ্গে নতুন কোনো সুযোগ খোঁজা — এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে রফিক প্রতিনিয়ত ক্লান্ত।

বিকল্প চিন্তা: ছোট উদ্যোগের স্বপ্ন

চাকরি না পেয়ে রফিক এখন ভাবছেন একটি ছোট ব্যবসা শুরু করার কথা। হয়তো অনলাইনভিত্তিক কিছু, কিংবা একটি ছোট কফির দোকান। তবে, ঝুঁকি, পুঁজি ও স্থায়িত্ব নিয়ে তার মনে দোলাচল রয়েছে। ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য কিছু শুরু করার সাহস পান না, আবার বসে থাকাও সম্ভব নয়।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান প্রেক্ষিত

রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ

রফিকুল ইসলামের মতো শত শত মধ্যবয়সী মানুষ এই মুহূর্তে দেশের নানা প্রান্তে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা মূল্যায়নের বদলে, তারা হয় অবহেলিত, নয় বিস্মৃত। রাষ্ট্রের উচিত, এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা। না হলে, কর্মক্ষম বয়সে তারা হয়ে পড়বেন নিঃস্ব ও অবসাদগ্রস্ত।

হার না মানা মন

সব হতাশার মাঝেও রফিক বলেন, “আমি হার মানিনি। হয়তো আগামীকালই একটা সুযোগ আসবে।” তার এই মনোবলই প্রমাণ করে, সমাজ যদি একটু পাশে দাঁড়ায়, তাহলে অভিজ্ঞ মানুষগুলো নতুন করে গড়ে তুলতে পারেন নিজেদের ভবিষ্যৎ, আর দেশেরও।