০৯:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫

জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ, মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা

  • Sarakhon Report
  • ১১:৪৩:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৫
  • 21

ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র জনকণ্ঠের সম্পাদককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে নিজেরাই একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করেছে পত্রিকাটির একদল কর্মী, যারা গত বছর ৫ই অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

শনিবার তাদের কয়েকজনকে মালিকপক্ষ চাকুরিচ্যুত করার পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সম্পাদককে অবাঞ্চিত ঘোষণা ছাড়াও তারা মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন।

জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান শনিবার রাতে ষড়যন্ত্র করে জনকন্ঠ ভবনে ‘মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখলের’ অভিযোগ করেছেন। তার এই অভিযোগ গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চীফ অপারেটিং অফিসার অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমান, এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক ও পত্রিকাটির প্লানিং এডভাইজর জয়নাল আবেদীন শিশিরসহ বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন সাংবাদিকের বিরু্ধে।

আফিজুর রহমান ও জয়নাল আবেদীন শিশির উভয়েই বিবিসি বাংলার কাছে জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

“দখলের অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্য। আমরা এখনো মালিকানা ও প্রকাশনায় নেই। পরিচালনার জন্য শুধু একটা বোর্ড করেছি। কর্মরত সব সাংবাদিকদের সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি একই সাথে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির একজন যুগ্ম আহবায়ক।

এদিকে আজ সকাল থেকেই পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক ও প্রকাশকের নাম দেখা যাচ্ছে না।

এর বদলে লেখা হচ্ছে: “সম্পাদক মন্ডলী কর্তৃক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার-এর সদস্য প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে গ্লোব প্রিন্টার্স লি: ও জনকণ্ঠ লি: থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত”।

এর আগে গতরাতে জনকণ্ঠ ভবনের সামনে এক সমাবেশে মীর জসিম নামে একজন নিজেকে নতুন সম্পাদকীয় বোর্ডের একজন হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেছেন: “জনকণ্ঠ ও সম্পাদক হিসেবে যিনি আছেন তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি। তবে তিনি প্রকাশক হিসেবে থাকবেন। তার দুই ছেলেকে জনকণ্ঠে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে”।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার পর এটি এক সময় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলো। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশ বিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্য ছিলো তাদের নিয়ে ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামে সিরিজ প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছিলো।

তবে পরবর্তীতে এটি আওয়ামী লীগ পন্থী পত্রিকা হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে।

গত বছর পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এর নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ বিরোধীদের বিশেষ করে জামায়াত ও এনসিপি সমর্থিত ব্যক্তিদের হাতে চলে যায় বলে আলোচনা আছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিকানা থেকে শুরু করে কর্মী পর্যায় পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে। কোথাও কোথাও চাপ দিয়ে বা মব তৈরি করেও পরিবর্তন আনার অভিযোগ আছে।

জনকন্ঠের অনলাইনে এভাবেই নতুন সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা করা হয়েছে

জনকণ্ঠ নিয়ে যা যা হলো

পত্রিকাটির মালিক পক্ষ, মালিক-বিরোধী গ্রুপ এবং কর্মীদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাহলো আওয়ামী লীগের পতনের কিছুদিন আগে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চীফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা আফিজুর রহমান।

মালিক পক্ষ অভিযোগ করেছে,আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সাথে জড়িত কয়েকজনকে পত্রিকাটিতে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেন। একজন বিএনপি নেতার স্ত্রীকেও তিনি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন।

পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক শামীমা এ খান বিবিসি বাংলাকে অভিযোগ করেন, আফিজুর রহমানই পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজন এনেছে এবং তারা ষড়যন্ত্র করে পত্রিকা দখল করেছে।

“তারাই অগাস্টে পত্রিকার ব্যানারে লাল-কালো ইস্যু তুলে সাবোটাজ করেছে। নিজেরাই পত্রিকার টেম্পলেট কালো করে আমাদের নামে প্রচার করে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আফিজুর রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানকে সেইফ ও সাসটেইন রাখতে যা করার নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটিই তিনি করেছেন।

“হাউজ দখলের প্রশ্নই আসে না। এ ধরনের অভিযোগ আমি ডিজার্ভ করি না। ম্যাডাম (সম্পাদক) অনেকগুলো অসত্য বলেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান, যিনি আওয়ামী লীগ আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইতে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

এর আগে মে মাসেও জনকণ্ঠ ভবনে মব তৈরি করে হামলার অভিযোগ উঠেছিলো। তখনো এনসিপি নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলে দল থেকে তার কাছে ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়েছিলো।

তবে এর আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির পুরনো সাংবাদিকদের অনেককে চাকরী থেকে বাদ দেওয়া হয়। আবার অনেকে নিজেরাই চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেন।

ভবনের প্রবেশপথে জনকন্ঠের প্রতিষ্ঠাতা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের ছবি দেখা যাচ্ছে

শামীমা এ খান বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অবহিত না করেই কিংবা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগ আনতে সহায়ক হবে, এমন কথা বলে কয়েকজনকে আফিজুর রহমান জনকণ্ঠে চাকরী দিয়েছেন।

সবশেষ অগাস্ট থেকে পত্রিকার ব্যানার লাল ও কালো করা নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে বিরোধ বাড়ে। এ ঘটনার জের ধরে মালিকপক্ষ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সমর্থক হিসেবে আসা নয় জনকে চাকরীচ্যুত করলে তারাও পাল্টা অবস্থান নেয়।

একপর্যায়ে জনকণ্ঠের সব কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেয় তারা। শুক্রবার রাত থেকে এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় জনকণ্ঠ ভবনে। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাতে চাকুরীচ্যুতরা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করে জনকণ্ঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

“অনেক দিন ধরেই ষড়যন্ত্র করছিলো তারা। এখন নিজেরাই কালো রং করে সাবোটাজ করেছে। অথচ আমরা পত্রিকার ব্যানার লালই করেছি। কিন্তু এটাকে ইস্যু করেই তারা পত্রিকা দখলের ষড়যন্ত্র করেছে,” বলছিলেন শামীমা এ খান।

তবে মালিকপক্ষ পত্রিকা দখলের চেষ্টার জন্য এনসিপির যেই নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে, তিনি বলছেন তিনিসহ যাদের চাকরীচ্যুত করা হয়েছে তারা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা ‘স্বপদে বহাল আছেন’।

“আমরা মালিক পক্ষের সাথে দুদিন ধরে আলোচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আসেনি। তারা পত্রিকার ব্যানারে কালো রং ধারণ করে আমাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। মালিক পক্ষের দুই তিন জন লোক আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এটি করেছে। সব সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড দরকার। সেটি করেছি এবং একটাও মামলাও করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জয়নাল আবেদীন শিশির।

এমন সংবাদ দেখা যাচ্ছে জনকন্ঠের অনলাইনে

মি. শিশির জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অসত্য দাবি করে বলেন, “আমরা এখনো মালিকানা ও প্রকাশনায় নেই। পরিচালনার জন্য শুধু একটা বোর্ড করেছি। কর্মরত সব সাংবাদিকরা সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাড়ে চার কোটি টাকা বকেয়া বেতন আছে। এগুলো তারা পরিশোধ করছে না। তারা প্রতিষ্ঠান না চালালে তাহলে আমাদের বেতন ভাতা দিয়ে যেতে পারে। তারা গোঁয়ার্তুমি করছে”।

শামীমা এ খানের দাবি হলো, জনকণ্ঠের কিছু পুরনো কর্মী কিছু সমস্যা তৈরি করেছিলো এবং সেই সুযোগে জামায়াত ও এনসিপি সমর্থিতদের জনকণ্ঠেআনা হয়।

“তারা আমাকে ও আমার সন্তানদের নিষিদ্ধ করেছে। জনকণ্ঠ ভবন দখল করেছে। অ্যাকাউন্টসের তিনটি ফ্লোরের চাবি নিয়ে গেছে। অথচ এটা আমাদের প্রতিষ্ঠান। মব সৃষ্টি করে তারা অবৈধ দখল করেছে। এটা একটা মিডিয়া ও কর্পোরেট অফিস। আমরা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাইনি,” বলছিলেন তিনি।

তার ছেলে জিশাল আতিকুল্লাহ খান বলছেন, কয়েকজন কর্মচারী প্রতিষ্ঠান দখল করে হাতিরঝিল থানায় উল্টো মামলা করেছে।

আফিজুর রহমান বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে জনকণ্ঠে তিনি যোগ দেওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটা পেশাদারিত্বের সাথে করা হয়েছে।

“এখন যে ৭/৮ জনকে টার্মিনেট করা হলো, সেটা আমি জানতাম না। পরশু রাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিলো। আমি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সবাই আলোচনা করে পত্রিকা লাল করা হয়েছে ম্যাডামের পারমিশন নিয়েই। আমি আমার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি গত এক বছর,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

তার ইন্ধনে পত্রিকা দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “ডুবন্ত এ প্রতিষ্ঠান দখল করবে কে? তাদের এতো ঋণ। আর অনেক দিন ধরে তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকি তৈরি হয়েছে যে- জনকণ্ঠ দখল করবে। প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য আমরা যেখানে যতটা করার সক্ষমতা ছিলো আমি করেছি”।

 বিবিসি নিউজ বাংলা

জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ, মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা

১১:৪৩:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৫

ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র জনকণ্ঠের সম্পাদককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে নিজেরাই একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করেছে পত্রিকাটির একদল কর্মী, যারা গত বছর ৫ই অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

শনিবার তাদের কয়েকজনকে মালিকপক্ষ চাকুরিচ্যুত করার পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সম্পাদককে অবাঞ্চিত ঘোষণা ছাড়াও তারা মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেছেন।

জনকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শামীমা এ খান শনিবার রাতে ষড়যন্ত্র করে জনকন্ঠ ভবনে ‘মব সৃষ্টি করে অবৈধভাবে দখলের’ অভিযোগ করেছেন। তার এই অভিযোগ গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চীফ অপারেটিং অফিসার অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফিজুর রহমান, এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক ও পত্রিকাটির প্লানিং এডভাইজর জয়নাল আবেদীন শিশিরসহ বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন সাংবাদিকের বিরু্ধে।

আফিজুর রহমান ও জয়নাল আবেদীন শিশির উভয়েই বিবিসি বাংলার কাছে জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

“দখলের অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্য। আমরা এখনো মালিকানা ও প্রকাশনায় নেই। পরিচালনার জন্য শুধু একটা বোর্ড করেছি। কর্মরত সব সাংবাদিকদের সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি একই সাথে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির একজন যুগ্ম আহবায়ক।

এদিকে আজ সকাল থেকেই পত্রিকাটির অনলাইন ভার্সনের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক ও প্রকাশকের নাম দেখা যাচ্ছে না।

এর বদলে লেখা হচ্ছে: “সম্পাদক মন্ডলী কর্তৃক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার-এর সদস্য প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে গ্লোব প্রিন্টার্স লি: ও জনকণ্ঠ লি: থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত”।

এর আগে গতরাতে জনকণ্ঠ ভবনের সামনে এক সমাবেশে মীর জসিম নামে একজন নিজেকে নতুন সম্পাদকীয় বোর্ডের একজন হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেছেন: “জনকণ্ঠ ও সম্পাদক হিসেবে যিনি আছেন তাকে সম্পাদকের পদ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছি। তবে তিনি প্রকাশক হিসেবে থাকবেন। তার দুই ছেলেকে জনকণ্ঠে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে”।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে আতিকউল্লাহ খান মাসুদ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠার পর এটি এক সময় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলো। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাংলাদেশ বিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্য ছিলো তাদের নিয়ে ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামে সিরিজ প্রকাশ করে আলোচনায় এসেছিলো।

তবে পরবর্তীতে এটি আওয়ামী লীগ পন্থী পত্রিকা হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে।

গত বছর পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এর নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ বিরোধীদের বিশেষ করে জামায়াত ও এনসিপি সমর্থিত ব্যক্তিদের হাতে চলে যায় বলে আলোচনা আছে।

তবে অভিযোগ রয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকার অনেক সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিকানা থেকে শুরু করে কর্মী পর্যায় পর্যন্ত পরিবর্তন হয়েছে। কোথাও কোথাও চাপ দিয়ে বা মব তৈরি করেও পরিবর্তন আনার অভিযোগ আছে।

জনকন্ঠের অনলাইনে এভাবেই নতুন সম্পাদকীয় বোর্ডের ঘোষণা করা হয়েছে

জনকণ্ঠ নিয়ে যা যা হলো

পত্রিকাটির মালিক পক্ষ, মালিক-বিরোধী গ্রুপ এবং কর্মীদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাহলো আওয়ামী লীগের পতনের কিছুদিন আগে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চীফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা আফিজুর রহমান।

মালিক পক্ষ অভিযোগ করেছে,আওয়ামী লীগের পতনের পর তিনি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সাথে জড়িত কয়েকজনকে পত্রিকাটিতে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেন। একজন বিএনপি নেতার স্ত্রীকেও তিনি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন।

পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক শামীমা এ খান বিবিসি বাংলাকে অভিযোগ করেন, আফিজুর রহমানই পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজন এনেছে এবং তারা ষড়যন্ত্র করে পত্রিকা দখল করেছে।

“তারাই অগাস্টে পত্রিকার ব্যানারে লাল-কালো ইস্যু তুলে সাবোটাজ করেছে। নিজেরাই পত্রিকার টেম্পলেট কালো করে আমাদের নামে প্রচার করে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

আফিজুর রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানকে সেইফ ও সাসটেইন রাখতে যা করার নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটিই তিনি করেছেন।

“হাউজ দখলের প্রশ্নই আসে না। এ ধরনের অভিযোগ আমি ডিজার্ভ করি না। ম্যাডাম (সম্পাদক) অনেকগুলো অসত্য বলেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান, যিনি আওয়ামী লীগ আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইতে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

এর আগে মে মাসেও জনকণ্ঠ ভবনে মব তৈরি করে হামলার অভিযোগ উঠেছিলো। তখনো এনসিপি নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলে দল থেকে তার কাছে ব্যাখ্যাও দাবি করা হয়েছিলো।

তবে এর আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানটির পুরনো সাংবাদিকদের অনেককে চাকরী থেকে বাদ দেওয়া হয়। আবার অনেকে নিজেরাই চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেন।

ভবনের প্রবেশপথে জনকন্ঠের প্রতিষ্ঠাতা আতিকউল্লাহ খান মাসুদের ছবি দেখা যাচ্ছে

শামীমা এ খান বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাকে অবহিত না করেই কিংবা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগ আনতে সহায়ক হবে, এমন কথা বলে কয়েকজনকে আফিজুর রহমান জনকণ্ঠে চাকরী দিয়েছেন।

সবশেষ অগাস্ট থেকে পত্রিকার ব্যানার লাল ও কালো করা নিয়ে দু পক্ষের মধ্যে বিরোধ বাড়ে। এ ঘটনার জের ধরে মালিকপক্ষ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি সমর্থক হিসেবে আসা নয় জনকে চাকরীচ্যুত করলে তারাও পাল্টা অবস্থান নেয়।

একপর্যায়ে জনকণ্ঠের সব কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দেয় তারা। শুক্রবার রাত থেকে এ নিয়ে ব্যাপক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয় জনকণ্ঠ ভবনে। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাতে চাকুরীচ্যুতরা সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন করে জনকণ্ঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

“অনেক দিন ধরেই ষড়যন্ত্র করছিলো তারা। এখন নিজেরাই কালো রং করে সাবোটাজ করেছে। অথচ আমরা পত্রিকার ব্যানার লালই করেছি। কিন্তু এটাকে ইস্যু করেই তারা পত্রিকা দখলের ষড়যন্ত্র করেছে,” বলছিলেন শামীমা এ খান।

তবে মালিকপক্ষ পত্রিকা দখলের চেষ্টার জন্য এনসিপির যেই নেতা জয়নাল আবেদীন শিশিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে, তিনি বলছেন তিনিসহ যাদের চাকরীচ্যুত করা হয়েছে তারা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা ‘স্বপদে বহাল আছেন’।

“আমরা মালিক পক্ষের সাথে দুদিন ধরে আলোচনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আসেনি। তারা পত্রিকার ব্যানারে কালো রং ধারণ করে আমাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। মালিক পক্ষের দুই তিন জন লোক আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এটি করেছে। সব সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পত্রিকাটি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে একটি সম্পাদকীয় বোর্ড দরকার। সেটি করেছি এবং একটাও মামলাও করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জয়নাল আবেদীন শিশির।

এমন সংবাদ দেখা যাচ্ছে জনকন্ঠের অনলাইনে

মি. শিশির জনকণ্ঠ দখলের অভিযোগ অসত্য দাবি করে বলেন, “আমরা এখনো মালিকানা ও প্রকাশনায় নেই। পরিচালনার জন্য শুধু একটা বোর্ড করেছি। কর্মরত সব সাংবাদিকরা সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাড়ে চার কোটি টাকা বকেয়া বেতন আছে। এগুলো তারা পরিশোধ করছে না। তারা প্রতিষ্ঠান না চালালে তাহলে আমাদের বেতন ভাতা দিয়ে যেতে পারে। তারা গোঁয়ার্তুমি করছে”।

শামীমা এ খানের দাবি হলো, জনকণ্ঠের কিছু পুরনো কর্মী কিছু সমস্যা তৈরি করেছিলো এবং সেই সুযোগে জামায়াত ও এনসিপি সমর্থিতদের জনকণ্ঠেআনা হয়।

“তারা আমাকে ও আমার সন্তানদের নিষিদ্ধ করেছে। জনকণ্ঠ ভবন দখল করেছে। অ্যাকাউন্টসের তিনটি ফ্লোরের চাবি নিয়ে গেছে। অথচ এটা আমাদের প্রতিষ্ঠান। মব সৃষ্টি করে তারা অবৈধ দখল করেছে। এটা একটা মিডিয়া ও কর্পোরেট অফিস। আমরা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাইনি,” বলছিলেন তিনি।

তার ছেলে জিশাল আতিকুল্লাহ খান বলছেন, কয়েকজন কর্মচারী প্রতিষ্ঠান দখল করে হাতিরঝিল থানায় উল্টো মামলা করেছে।

আফিজুর রহমান বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে জনকণ্ঠে তিনি যোগ দেওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটা পেশাদারিত্বের সাথে করা হয়েছে।

“এখন যে ৭/৮ জনকে টার্মিনেট করা হলো, সেটা আমি জানতাম না। পরশু রাতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিলো। আমি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সবাই আলোচনা করে পত্রিকা লাল করা হয়েছে ম্যাডামের পারমিশন নিয়েই। আমি আমার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি গত এক বছর,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

তার ইন্ধনে পত্রিকা দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, “ডুবন্ত এ প্রতিষ্ঠান দখল করবে কে? তাদের এতো ঋণ। আর অনেক দিন ধরে তাদের মধ্যে এক ধরনের সাইকি তৈরি হয়েছে যে- জনকণ্ঠ দখল করবে। প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য আমরা যেখানে যতটা করার সক্ষমতা ছিলো আমি করেছি”।

 বিবিসি নিউজ বাংলা