অবশেষে শুরু হচ্ছে তামা উত্তোলনের কাজ
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় লোগার প্রদেশে অবস্থিত মেস আয়নাক খনিতে প্রায় দুই দশক পর চীন-সমর্থিত একটি বড় তামা উত্তোলন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তবে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ এখনো এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ করপোরেশন (MCC) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে তারা চলতি বছরেই খনিতে তামা উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত, যদি সরকারের সঙ্গে আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলো নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়।
২০০৮ সালে ৩০ বছরের একটি চুক্তির মাধ্যমে MCC মেস আয়নাক প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি, ব্রোঞ্জ যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যুদ্ধকালীন সময়ের স্থাপিত মাইন এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে প্রকল্পটি একাধিকবার বিলম্বিত হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণে খনন পদ্ধতির পরিবর্তন
২০২৪ সালে তালেবান প্রশাসন ঘোষণা দেয় যে তারা ওপেন-পিট খনন থেকে সরে এসে ভূগর্ভস্থ খননের দিকে এগোবে। যদিও এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের দিক থেকে এটি অধিক নিরাপদ। তারা আরও জানায়, খননকাজ চলাকালে ঐতিহাসিক নিদর্শন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করা হবে।
তালেবান ও চীনের ভিন্ন স্বার্থ
চীনের লানঝু বিশ্ববিদ্যালয়ের আফগানিস্তান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ঝু ইয়ংবিয়াও মনে করেন, এই প্রকল্পটি তালেবান শাসনের জন্য রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে তালেবান।
ঝু বলেন, “এই প্রকল্পটি তালেবান এবং আগের মার্কিন-সমর্থিত সরকারের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তারা আশা করেছিল এটি আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।”
তবে চীনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রকল্পের ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে সীমিত। MCC অনেক হিসাব-নিকাশ করেই প্রকল্পটি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ তালেবানের সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করার চাপে তারা ছিল।
বিনিয়োগ বাড়লেও আয় নেই
MCC-এর প্রতিনিধি ডেং গুওপিং জানিয়েছেন, “আমরা ইতোমধ্যে ৪৩ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছি, অথচ এখনো কোনো আয় পাইনি।”
প্রকল্পের মোট ব্যয় এরই মধ্যে ২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, কারণ তামা উত্তোলনের প্রযুক্তি ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
কৌশলগত সম্পদ: তামার গুরুত্ব
তামা হলো বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যাটারি এবং সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য অপরিহার্য এক কৌশলগত সম্পদ। জাতিসংঘের বাণিজ্য সংস্থা ইউএনকট্যাড-এর মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বে তামার চাহিদা ৪০ শতাংশের বেশি বাড়বে, কিন্তু সরবরাহ সেই অনুপাতে বাড়ছে না।
মেস আয়নাক খনিতে প্রায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টন আকরিক রয়েছে, যা থেকে ১ কোটি ১০ লাখ টনেরও বেশি ধাতব তামা পাওয়া যেতে পারে।
বিশ্বের বৃহত্তম তামা ব্যবহারকারী দেশ চীন, বিশ্ব সরবরাহের ৬০ শতাংশ আমদানি করে এবং ৪৫ শতাংশ পরিশোধিত তামা উৎপাদন করে। তাই আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে চীন তামার নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্রিয় রয়েছে।
রাজনৈতিক ঝুঁকি ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা
ঝু ইয়ংবিয়াও সতর্ক করে বলেন, মেস আয়নাক প্রকল্পের বড় ঝুঁকি হলো তালেবান সরকারের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চুক্তি রক্ষা না করার প্রবণতা।
২০২৩ সালে তালেবান সরকার একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত তেল উত্তোলন ও উন্নয়ন চুক্তি বাতিল করে, চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে। ঝু বলেন, “তালেবান অনুরূপ সিদ্ধান্ত অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রেও নিতে পারে।”
এছাড়া, যদি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হয়, তাহলে মেস আয়নাক প্রকল্পেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে।
চীন-আফগানিস্তান সম্পর্ক: সীমিত অগ্রগতি
চীন আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও কাবুলে দূতাবাস চালু রেখেছে এবং ২০২৩ সালে আফগানিস্তানে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়, যা ছিল কোনো দেশের পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ।

তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি মে মাসে চীন সফর করেন এবং সেখানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে চীন আফগানিস্তানকে অবকাঠামো উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
এছাড়াও, চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আঞ্চলিক শান্তির লক্ষ্যে ঐক্যমতের ঘোষণা আসে।
রপ্তানি চুক্তি ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতার সীমাবদ্ধতা
২০২৫ সালের মার্চ মাসে চীন ও আফগানিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি যৌথ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির আওতায় আফগান পাইন নাট, ডালিম, মূল্যবান পাথর ও খনিজ পদার্থ রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে ঝু ইয়ংবিয়াও বলেন, “সহযোগিতার খুব বেশি সম্প্রসারণের সুযোগ নেই।” কারণ তালেবান এখনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, নারী অধিকার রক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদ দমন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বিশেষ করে চীনের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হলো পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ETIM) এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় তালেবানের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব।
চীন আশা করছে, তালেবান অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন, নারীদের অধিকার রক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
ঝু বলেন, “চীন সবসময় চায় আফগানিস্তান তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে, সুসম্পর্ক বজায় রাখুক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করুক। কে শাসন করছে, তার চেয়ে এই নীতিই চীনের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















