০৬:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫
নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল মাইক্রোসফট ও জি৪২ সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডেটা-সেন্টার বিস্তার ঘোষণা বড় টেকের চাপের মুখে ইইউ এইআই আইন বাস্তবায়ন বিলম্বে বিবেচনায় বাংলাদেশ আমেরিকা থেকে গম কিনছে, বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে বড় পদক্ষেপ ব্লেক লাইভলির মামলায় সাক্ষী টেইলর সুইফট ও হিউ জ্যাকম্যান; ক্ষতিপূরণের দাবি ১৬১ মিলিয়ন ডলার ডাক রাশ্মিকার ‘দ্য গার্লফ্রেন্ড’ প্রথম দিনেই ব্যর্থতার মুখে ৩ দফা দাবি: শহীদ মিনারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচি গাজীপুরে তুলার গুদামে আগুন নিয়ন্ত্রণে সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রাল চার্চে বিস্ফোরণ: তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ

মালয়েশিয়া থেকে জোরপূর্বক ফেরত: ‘রুবেল’-এর জীবনের পথ উল্টে যাওয়া

প্রবাসের স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে

রুবেল (ছদ্মনাম) নরসিংদীর এক গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সীমিত হলেও তাঁর পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়েছিল। তবে বাবার অসুস্থতা ও সংসারের চাপ তাঁকে অল্প বয়সেই উপার্জনের পথে নামতে বাধ্য করে। এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি ২০১৮ সালের শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় এক রিক্রুটিং এজেন্সি ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ঋণ নিয়ে গৃহস্থালি জমি বন্ধক রেখে রুবেল বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি নেন। প্রবাসে তাঁর আশা ছিল—প্রতিদিনের কষ্টের বিনিময়ে পরিবারের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তা গড়ে তোলা।

প্রবাসের জীবন ও কর্মপরিস্থিতি

মালয়েশিয়ায় পৌঁছে রুবেল একটি আসবাবপত্র তৈরির কারখানায় কাজ পান। চুক্তি অনুযায়ী দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় ১৪ ঘণ্টা হয়ে যেত। মাসে ১,২০০ রিঙ্গিত বেতনের মধ্যে ওভারটাইমের অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হলেও তা খুব সীমিত ছিল। তবুও তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন—কারণ দেশে পরিবারের জন্য টাকা পাঠানোই তাঁর মূল লক্ষ্য।

Securing the Future of Malaysia's Furniture Industry - MIDA | Malaysian  Investment Development Authority

কিন্তু কয়েক মাস পর কোম্পানির আর্থিক সংকট দেখা দেয়। বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের খরচ কোম্পানি বহন না করায় রুবেলের কাগজপত্র অবৈধ অবস্থায় চলে যায়। তিনি মালয়েশিয়ায় ‘অবৈধ শ্রমিক’ হিসেবে চিহ্নিত হন, যদিও সমস্যাটি ছিল নিয়োগকর্তার অবহেলার ফল।

অভিযানের রাত: গ্রেপ্তার ও আটক

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের এক গভীর রাতে মালয়েশিয়ান অভিবাসন পুলিশ হঠাৎ অভিযানে যায় তাঁর থাকার ডরমিটরিতে। পরিচয়পত্রের মেয়াদ শেষ থাকায় রুবেলসহ আরও কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। আটককালে তাঁদের মোবাইল ফোন, নগদ অর্থ এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও নিয়ে নেওয়া হয়।

রুবেল জানান, আটক কেন্দ্রে অবস্থার অবনতি ছিল ভয়াবহ—অতিরিক্ত ভিড়, অপর্যাপ্ত খাবার এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা তেমনভাবে পাওয়া যায়নি।

মালয়েশিয়ায় বিমানবন্দর থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ...

জোরপূর্বক দেশে ফেরত

তিন মাস আটক থাকার পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে রুবেলকে একটি ফেরত ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়। দেশে ফেরার আগে তাঁকে নিজ খরচে ‘ওয়ান-ওয়ে’ টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়। মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে তাঁর চোখে ছিল পরাজয়ের ছাপ—স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আর পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা।

ঢাকায় পৌঁছে বিমানবন্দরে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে গ্রহণ করেন, কিন্তু আনন্দের পরিবর্তে ছিল এক ধরনের হতাশা ও লজ্জা। তিনি ঋণের বোঝা, চাকরিহীন অবস্থা এবং সামাজিক চাপের মধ্যে পড়ে যান।

চিত্র:Garments Factory in Bangladesh.JPG - উইকিপিডিয়া

দেশে ফেরার পর সংগ্রাম

ফেরার পর রুবেল স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে অল্প বেতনের চাকরি নেন, তবে তা দিয়ে ঋণ শোধ করা অসম্ভব। গ্রামে অনেকে তাঁর ব্যর্থতাকে তির্যক মন্তব্যে প্রকাশ করে, যা তাঁর মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।

রুবেলের কথায়,
“আমি মালয়েশিয়ায় অবৈধ হতে চাইনি, কিন্তু নিয়োগকর্তার কারণে কাগজপত্র ঠিক হয়নি। এখন দেশে ফিরে ঋণ শোধ করাই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

প্রতারণার শিকার মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা, প্রবেশের সময়সীমা শেষ,  বিমানবন্দরেই আটকে রইলেন হাজারো কর্মী | The Business Standard

বিশেষজ্ঞ মতামত

বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুবেলের মতো হাজারো প্রবাসী নিয়োগকর্তার অবহেলা, দুর্বল আইনগত সহায়তা এবং রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হন। তাঁদের মতে, শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে এবং প্রবাসে অবস্থানকালে সরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা ও পর্যবেক্ষণ জোরদার করা জরুরি।

ব্যর্থতার চেয়ে অনেক বেশি

রুবেলের গল্প একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতার চেয়ে অনেক বেশি—এটি বাংলাদেশের অভিবাসন বাস্তবতার এক তীক্ষ্ণ প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন হাজারো মানুষ প্রবাসে স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা, নিয়োগকর্তার অবহেলা ও আইনগত ফাঁকফোকর তাঁদের জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। রুবেলের মতো মানুষদের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সহায়তা নিশ্চিত করা না হলে এ ধরনের ট্র্যাজেডি বারবার ঘটতেই থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নাইজেরিয়া বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইন পাস করল

মালয়েশিয়া থেকে জোরপূর্বক ফেরত: ‘রুবেল’-এর জীবনের পথ উল্টে যাওয়া

০৬:০৬:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫

প্রবাসের স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে

রুবেল (ছদ্মনাম) নরসিংদীর এক গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সীমিত হলেও তাঁর পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়েছিল। তবে বাবার অসুস্থতা ও সংসারের চাপ তাঁকে অল্প বয়সেই উপার্জনের পথে নামতে বাধ্য করে। এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি ২০১৮ সালের শেষ দিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় এক রিক্রুটিং এজেন্সি ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ঋণ নিয়ে গৃহস্থালি জমি বন্ধক রেখে রুবেল বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি নেন। প্রবাসে তাঁর আশা ছিল—প্রতিদিনের কষ্টের বিনিময়ে পরিবারের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তা গড়ে তোলা।

প্রবাসের জীবন ও কর্মপরিস্থিতি

মালয়েশিয়ায় পৌঁছে রুবেল একটি আসবাবপত্র তৈরির কারখানায় কাজ পান। চুক্তি অনুযায়ী দৈনিক ১০ ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও বাস্তবে তা প্রায় ১৪ ঘণ্টা হয়ে যেত। মাসে ১,২০০ রিঙ্গিত বেতনের মধ্যে ওভারটাইমের অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হলেও তা খুব সীমিত ছিল। তবুও তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন—কারণ দেশে পরিবারের জন্য টাকা পাঠানোই তাঁর মূল লক্ষ্য।

Securing the Future of Malaysia's Furniture Industry - MIDA | Malaysian  Investment Development Authority

কিন্তু কয়েক মাস পর কোম্পানির আর্থিক সংকট দেখা দেয়। বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের খরচ কোম্পানি বহন না করায় রুবেলের কাগজপত্র অবৈধ অবস্থায় চলে যায়। তিনি মালয়েশিয়ায় ‘অবৈধ শ্রমিক’ হিসেবে চিহ্নিত হন, যদিও সমস্যাটি ছিল নিয়োগকর্তার অবহেলার ফল।

অভিযানের রাত: গ্রেপ্তার ও আটক

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের এক গভীর রাতে মালয়েশিয়ান অভিবাসন পুলিশ হঠাৎ অভিযানে যায় তাঁর থাকার ডরমিটরিতে। পরিচয়পত্রের মেয়াদ শেষ থাকায় রুবেলসহ আরও কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়। আটককালে তাঁদের মোবাইল ফোন, নগদ অর্থ এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও নিয়ে নেওয়া হয়।

রুবেল জানান, আটক কেন্দ্রে অবস্থার অবনতি ছিল ভয়াবহ—অতিরিক্ত ভিড়, অপর্যাপ্ত খাবার এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা তেমনভাবে পাওয়া যায়নি।

মালয়েশিয়ায় বিমানবন্দর থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি ...

জোরপূর্বক দেশে ফেরত

তিন মাস আটক থাকার পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে রুবেলকে একটি ফেরত ফ্লাইটে তুলে দেওয়া হয়। দেশে ফেরার আগে তাঁকে নিজ খরচে ‘ওয়ান-ওয়ে’ টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়। মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে তাঁর চোখে ছিল পরাজয়ের ছাপ—স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট আর পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা।

ঢাকায় পৌঁছে বিমানবন্দরে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে গ্রহণ করেন, কিন্তু আনন্দের পরিবর্তে ছিল এক ধরনের হতাশা ও লজ্জা। তিনি ঋণের বোঝা, চাকরিহীন অবস্থা এবং সামাজিক চাপের মধ্যে পড়ে যান।

চিত্র:Garments Factory in Bangladesh.JPG - উইকিপিডিয়া

দেশে ফেরার পর সংগ্রাম

ফেরার পর রুবেল স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে অল্প বেতনের চাকরি নেন, তবে তা দিয়ে ঋণ শোধ করা অসম্ভব। গ্রামে অনেকে তাঁর ব্যর্থতাকে তির্যক মন্তব্যে প্রকাশ করে, যা তাঁর মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।

রুবেলের কথায়,
“আমি মালয়েশিয়ায় অবৈধ হতে চাইনি, কিন্তু নিয়োগকর্তার কারণে কাগজপত্র ঠিক হয়নি। এখন দেশে ফিরে ঋণ শোধ করাই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

প্রতারণার শিকার মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা, প্রবেশের সময়সীমা শেষ,  বিমানবন্দরেই আটকে রইলেন হাজারো কর্মী | The Business Standard

বিশেষজ্ঞ মতামত

বাংলাদেশ ও প্রবাসী কল্যাণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুবেলের মতো হাজারো প্রবাসী নিয়োগকর্তার অবহেলা, দুর্বল আইনগত সহায়তা এবং রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হন। তাঁদের মতে, শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে এবং প্রবাসে অবস্থানকালে সরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা ও পর্যবেক্ষণ জোরদার করা জরুরি।

ব্যর্থতার চেয়ে অনেক বেশি

রুবেলের গল্প একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতার চেয়ে অনেক বেশি—এটি বাংলাদেশের অভিবাসন বাস্তবতার এক তীক্ষ্ণ প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিন হাজারো মানুষ প্রবাসে স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমান, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা, নিয়োগকর্তার অবহেলা ও আইনগত ফাঁকফোকর তাঁদের জীবনকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। রুবেলের মতো মানুষদের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক সহায়তা নিশ্চিত করা না হলে এ ধরনের ট্র্যাজেডি বারবার ঘটতেই থাকবে।