বাংলাদেশে মাছ শুধু একটি খাদ্য নয়, বরং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদী, হাওর, বিল ও উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে মাছ ধরা এবং খাওয়ার রীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি, পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অস্থির ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় মাছের বাজারে সরাসরি চাপ পড়ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও মফস্বলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এখন মাছ কেনার ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতায় পড়েছে।
মাছ খাওয়ার হার ও গড় প্রাপ্যতা
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক গড়ে ৬২ গ্রাম মাছ খায়, যা প্রাণিজ প্রোটিনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জোগায়। ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের খাবারের তালিকায় মাছ প্রতিদিন থাকত। কিন্তু বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায়, বিশেষ করে রুই, কাতলা বা ইলিশের মতো মাঝারি ও বড় মাছ সাধারণ আয়ের মানুষের পক্ষে আগের মতো কেনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক পরিবার এখন সপ্তাহে তিন-চার দিনের বেশি মাছ রান্না করতে পারছে না, যা আগে প্রায় প্রতিদিনই ছিল।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি: আয়ের সীমা ও সংজ্ঞা
বাংলাদেশে আয়ের ভিত্তিতে মধ্যবিত্তের মাসিক পারিবারিক আয় ধরা হয় ১২,৫০০ থেকে ২১,৫০০ টাকা। এর নিচে যারা, তারা নিম্ন আয়ের শ্রেণিতে পড়ে, আর এই সীমার নিচের অংশকে বলা হয় ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’। এরা শহর ও মফস্বলের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, এমনকি রিকশা বা অটোরিকশা মালিক-চালকও হতে পারে। তারা আয়-ব্যয়ের হিসাবের মধ্যে প্রতিদিনের বাজার খরচ সামলায়, যেখানে মাছ একটি আবশ্যিক খাদ্য হলেও তার ধরণ ও পরিমাণ আয়ের উপর নির্ভরশীল।
বাজারের অস্থিরতা ও পরিবারের রান্নাঘরের হিসাব

বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো মাছের ক্ষেত্রে তুলনামূলক সস্তা প্রজাতির দিকে ঝুঁকছে—যেমন পাঙ্গাস, তেলাপিয়া বা কমন কার্প। আগে যেখানে সপ্তাহে দু’দিন বড় মাছ রান্না হতো, এখন তা কমে মাসে একবার হয়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে মাঝারি রুই বা কাতলার কেজি ৪০০–৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায়, অনেক পরিবার মাছের বদলে ডিম বা ডাল খাওয়ার দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শহর ও মফস্বলের পার্থক্য
ঢাকায় বাসা ভাড়া, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বেশি হওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্তের হাতে বাজারের জন্য বরাদ্দ অর্থ আরও কমে গেছে। ফলে মাছ কেনার ক্ষমতা এখানে তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। অন্যদিকে মফস্বল শহরে কিছুটা কম দামে মাছ পাওয়া গেলেও, আয়ের সীমাবদ্ধতা এবং স্থানীয় ব্যবসার অনিশ্চয়তা সেখানে একই চাপ তৈরি করছে।

বেকারত্ব ও অস্থির আয়ের প্রভাব
অস্বাভাবিক বেকারত্ব, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বেসরকারি খাতের ছাঁটাই, মধ্যবিত্তদের আয়কে অনিশ্চিত করেছে। যারা আগে প্রতিদিন মাছ খেতে পারতেন, তারা এখন সপ্তাহে দু’তিন দিন মাছ খাওয়াকে নিয়মে পরিণত করেছেন। কিছু পরিবার এমনকি মাছকে ‘উৎসবের খাবার’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।
ভবিষ্যতের আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে প্রোটিনের ঘাটতি বাড়তে পারে, যা বিশেষ করে শিশুদের পুষ্টিতে প্রভাব ফেলবে। নিম্ন-মধ্যবিত্তের খাদ্যাভ্যাসে মাছের গুরুত্ব কমে গেলে শুধু স্বাস্থ্য নয়, সাংস্কৃতিক অভ্যাসও পরিবর্তিত হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















