ভয়াবহ স্মৃতি ও বেদনার দীর্ঘ যাত্রা
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার বেঁচে যাওয়া মানুষদের (হিবাকুশা) জীবন তিনটি বড় ধাপের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রথম ধাপ—১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টের সেই বিভীষিকাময় দিন: চোখ ধাঁধানো আলো, ভয়ংকর বিস্ফোরণ, দগ্ধকর তাপ, কালো বৃষ্টি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর, পুড়ে যাওয়া দেহ। নাগাসাকিতে মাত্র চার বছর বয়সে সেই দৃশ্য দেখেছিলেন তানাকা শিগেমিৎসু, যিনি আজও বলেন—“এটা ছিল একেবারে নরক।” এরপর এলো নীরব কষ্টের দীর্ঘ দশক—বিকিরণের প্রভাব দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করল, সামাজিক কুসংস্কার মনকে আঘাত করল। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভর করল হতাশা—পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
৮০তম বার্ষিকী ও নতুন পারমাণবিক যুগ
এ বছর ৮০তম বার্ষিকীতে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ২০০৯ সালেও পারমাণবিক অস্ত্রকে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গম্ভীরভাবে পারমাণবিক-মুক্ত বিশ্বের কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, বিশ্ব প্রবেশ করেছে কৌশলবিদদের ভাষায় “তৃতীয় পারমাণবিক যুগে”—যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জটিল ও বিপজ্জনক। তানাকা, যিনি জাপানের হিবাকুশাদের সংগঠন নিপ্পন হিদানকিয়োর সহ-সভাপতি, বলেন—“গত ৮০ বছরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি এতটা কাছাকাছি কখনো আসেনি।”

পুরনো নিয়ম ভেঙে নতুন হুমকি
রাশিয়ার ইউক্রেনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এই নতুন যুগের সূচনা করলেও আসল পরিবর্তন আরও গভীর। শীতল যুদ্ধকালের অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ চুক্তির কাঠামো ভেঙে গেছে। মার্কিন-রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করার শেষ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ আগামী বছর শেষ হবে। বিদ্যমান পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো তাদের অস্ত্রাগার বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন করছে। মার্কিন পারমাণবিক ছাতার সুরক্ষা দুর্বল হচ্ছে, ফলে পোল্যান্ড, সৌদি আরব ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আলোচনা শুরু হয়েছে। এমনকি জাপানেও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রসঙ্গ আর পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য নয়।
দুর্বল হচ্ছে পারমাণবিক নিষেধের নীতি
বিশ্বব্যাপী ‘পারমাণবিক ট্যাবু’—যা এতদিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে নৈতিক বিরোধ গড়ে তুলেছিল—এখন দুর্বল হচ্ছে। হুমকি এখন আরও প্রকাশ্য। গত সপ্তাহেই, হিরোশিমা ও নাগাসাকির স্মরণ অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপ-প্রধান সামাজিক মাধ্যমে পারমাণবিক মন্তব্য বিনিময় করেন, যেন অনলাইন ট্রলের মতো।

হিবাকুশাদের লড়াই ও সীমাবদ্ধতা
হিবাকুশারা সবসময়ই বিশ্বকে নিরস্ত্রীকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। নিপ্পন হিদানকিয়ো গত বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে, কারণ তারা সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে পারমাণবিক অস্ত্র আর কখনো ব্যবহার করা উচিত নয়। হিবাকুশারা ২০১৭ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করার চুক্তি আনতেও বড় ভূমিকা রাখেন। তবে আশ্চর্যের কিছু নয়—বিশ্বের কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ সেই চুক্তিতে সই করেনি।
জাপানের দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তা নির্ভরতা
জাপান মনে করে, পারমাণবিক হামলার শিকার একমাত্র দেশ হিসেবে তার নিরস্ত্রীকরণের দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু দেশটির নিরাপত্তা তিনটি পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর (চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া) মোকাবিলায় পারমাণবিক প্রতিরোধের ওপর নির্ভর করে। ৬ আগস্ট হিরোশিমায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু প্রতিশ্রুতি দেন “পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়তে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবেন।” কিন্তু জাপানও নতুন জাতিসংঘ চুক্তিতে সই করেনি—যা হিবাকুশাদের হতাশ করেছে।

স্মৃতি সংরক্ষণের প্রয়াস
নাগাসাকির মেয়র সুজুকি শিরো সতর্ক করে বলেছেন—“আমরা এমন এক সময়ে পৌঁছাচ্ছি, যখন আর হিবাকুশারা বেঁচে থাকবেন না।” তাই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে তাদের স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ চলছে। উভয় শহরে ‘অ্যাটমিক-বোম লিগ্যাসি সাকসেসর’ বা স্মৃতি-উত্তরাধিকারী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যারা নির্দিষ্ট হিবাকুশার গল্প নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবেন।
শেষ প্রজন্মের সাক্ষী
বর্তমানে ১ লাখেরও কম স্বীকৃত হিবাকুশা জীবিত আছেন—যেখানে একসময় সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। জীবিতদের গড় বয়স ৮৬, এবং বেশিরভাগই বিস্ফোরণের সময় ছিলেন শিশু। হিবাকুশাদের কণ্ঠ যখন ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে আসছে, তখনই নতুন পারমাণবিক যুগের আগমন মোটেও কাকতালীয় নয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















