কল্পকাহিনি থেকে নিষেধাজ্ঞা
“এক লম্বা নখ দিয়ে সে সিল্ক আর লেইস ছিঁড়ে ফেলল, আর আমার অন্তর্বাস টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ল।” — এ ধরনের বর্ণনায় ভরপুর কল্পকাহিনি সবার পছন্দ নয়। তবে অনেক কিশোর-কিশোরী ও তরুণ পাঠক এগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়ে। এই ধারার অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সারা জে. মাস ৭ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি বই বিক্রি করেছেন। কিন্তু জাদুবিদ্যা ও অবৈধ যৌন সম্পর্ককে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে পাপ বলে মনে করা অনেকেই এতে ক্ষুব্ধ। তাই তাঁর পাঁচটি বই — যার মধ্যে A Court of Thorns and Roses রয়েছে — আমেরিকার স্কুলগুলোতে সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
বই নিষিদ্ধের বাড়ন্ত প্রবণতা
আমেরিকায় বই নিষিদ্ধকরণ ক্রমেই বাড়ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংগঠন পেন আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে প্রায় ১০ হাজার বই স্কুলে নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে — যা দুই বছরে চার গুণ বৃদ্ধি। পেন আমেরিকা বলছে, স্কুল লাইব্রেরি থেকে কন্টেন্টের কারণে বই সরানো বা সীমাবদ্ধ করাকেই তারা ‘ব্যান’ হিসেবে বিবেচনা করে, যা সাধারণত উদ্বিগ্ন অভিভাবক বা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের চাপের ফলে ঘটে।
যৌনতা, সহিংসতা ও সংবেদনশীল বিষয়
দুই বা তার বেশি স্কুল জেলায় নিষিদ্ধ হওয়া বইয়ের অর্ধেকেরও বেশি যৌনবিষয়ক কন্টেন্ট বহন করে। এর মধ্যে অনেকটাই ছিল হালকা মাত্রার। যেমন, টেনেসির মনরো কাউন্টিতে কেবল কভারে ক্লাসিক নগ্ন ভাস্কর্যের ছবি থাকার কারণে একটি বই নিষিদ্ধ হয়। কিশোর বয়সের ট্রমা বা মানসিক আঘাত নিয়ে লেখা বইও অনেক সময় অভিভাবকদের বিরক্তির কারণ হয়। এলেন হপকিন্সের তিনটি বই — যেখানে মাদক সেবন, আত্মক্ষতি ও দেহব্যবসার খোলামেলা বর্ণনা রয়েছে — সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ বইয়ের মধ্যে।

জাতিগত বৈষম্য নিয়ে লেখা বইও বাদ যায় না; মায়া অ্যাঞ্জেলোর I Know Why the Caged Bird Sings বা অ্যালিস ওয়াকারের The Colour Purple এর মতো ক্লাসিকও অনেক স্কুলে নিষিদ্ধ। সমকামিতা নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বই বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে; ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক বই আরও বেশি সেন্সরের শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ বই হচ্ছে জোডি পিকোল্টের Nineteen Minutes, যা স্কুলে বন্দুক হামলা নিয়ে লেখা হলেও মূল আপত্তি এর ‘ডেট রেপ’ বা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্কের বর্ণনায়। আরেকটি বহুল নিষিদ্ধ বই মার্গারেট অ্যাটউডের The Handmaid’s Tale, যেখানে নারীদের পড়তে নিষেধ করা হয় — যা বই নিষিদ্ধকারীদের ব্যঙ্গাত্মকভাবে আঘাত করলেও তারা তাতে গুরুত্ব দেয় না।
কঠোর রাজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব
ফ্লোরিডা ও আইওয়া বই সেন্সরে বিশেষভাবে সক্রিয়। ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডেস্যান্টিস স্কুল থেকে ‘ওক সংস্কৃতি’ সরানোর মিশনে নেমেছেন। আইওয়ার ‘প্যারেন্টাল রাইটস’ আইনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা অনুপযুক্ত বই পড়লে শিক্ষকেরা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন। এতে সময়ের অভাবে প্রশাসকরা এমনকি চ্যাটজিপিটিকে বইয়ের যৌনবিষয়ক কন্টেন্ট খুঁজতে বলছেন — যা দ্রুত হলেও অনেক সময় ভুল ফল দেয়।
গ্রন্থাগারিকদের হয়রানি
নিউ জার্সির স্কুল লাইব্রেরিয়ান মার্থা হিকসনকে স্কুল সুপারিনটেনডেন্ট একটি লেসবিয়ান প্রধান চরিত্রের গ্রাফিক নভেল সরাতে বলেছিলেন। তিনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর কিছু অভিভাবক তাকে ‘অশ্লীল লেখক’ ও ‘শিশু নির্যাতক’ বলে অভিযুক্ত করেন, যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার গাড়ি ভাঙচুর হয়, বাড়িতে নিরাপত্তা ক্যামেরা বসাতে হয়। হিকসনের মতে, এসব সংগঠিত খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদীদের কৌশল। এতে অনেক গ্রন্থাগারিক বিতর্কিত বই এড়িয়ে চলেন।

রাজনৈতিক মেরুকরণ ও নির্বাচনী কৌশল
কোন বই শিশুদের জন্য উপযুক্ত, এ নিয়ে যুক্তি-তর্ক থাকতেই পারে। তবে রাজনৈতিক কর্মীরা শিক্ষকের তুলনায় বইকে সহজ টার্গেট বানান — কারণ লাইব্রেরির বইয়ের তালিকা সবাই দেখতে পারে এবং কীওয়ার্ড দিয়ে খোঁজা যায়। নির্বাচনের বাইরের সময়েও কর্মীরা এই ইস্যুতে নিজেদের সমর্থকদের উত্তেজিত রাখতে লড়াই চালান।
হোয়াইট হাউস বনাম সেন্সরশিপ
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বই নিষিদ্ধকরণকে সমস্যা মনে করে এ নিয়ে তদন্তের জন্য ‘বুক ব্যান কো-অর্ডিনেটর’ নিয়োগ করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে এটিকে ‘বাইডেনের বই নিষিদ্ধকরণ ধোঁকা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে পদটি বাতিল করেন। সাংস্কৃতিক যোদ্ধারা এতে উল্লাস প্রকাশ করলেও অনেকে আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের অযৌক্তিক সেন্সরশিপ পাঠ-সংস্কৃতিকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















