কূটনৈতিক পরিবর্তনের নতুন ধারা
পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দীর্ঘদিনের দ্বিধা ভেঙে এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে বিষয়টিতে একমাত্র বড় ‘বিরোধী’ অবস্থানে ফেলে দিতে পারে।
যদি ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করে, তবে চীন ও রাশিয়া ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম স্থায়ী সদস্য হিসেবে তারা এই পদক্ষেপ নেবে—যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের জন্য প্রতীকী আঘাত হবে। সমর্থকরা বলছেন, এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানকে পুনরুজ্জীবিত করার কৌশল, আর সমালোচকরা মনে করছেন এটি সহিংসতাকে পুরস্কৃত করার সমান।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ
আন্তর্জাতিক আইনে (১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী) একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে স্থায়ী জনসংখ্যা, সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড, কার্যকর সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার সক্ষমতা থাকতে হয়। কোনো দেশকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে রাজনৈতিকভাবে তার সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা। যদিও রাষ্ট্র হওয়ার জন্য এটি আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, কিন্তু এটি কূটনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করে।

বর্তমানে কত দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে
জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৭টি ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের বর্তমান মর্যাদা স্থায়ী পর্যবেক্ষক, পূর্ণ সদস্য নয়। পশ্চিমা প্রভাবশালী অর্থনীতি ও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের পক্ষে বৈশ্বিক কূটনীতির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনবে।
স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর তালিকা (১৯৮৮-২০২৫)
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে স্বীকৃতির পরিকল্পনা: অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, মাল্টা, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য।
২০২৪: আর্মেনিয়া, বার্বাডোস, আয়ারল্যান্ড, জ্যামাইকা, নরওয়ে, স্লোভেনিয়া, স্পেন, দ্য বাহামাস, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো।
২০২৩: মেক্সিকো।
২০১৯: সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস।
২০১৮: কলম্বিয়া।
২০১৫: সেন্ট লুসিয়া, ভ্যাটিকান।
২০১৪: সুইডেন।
২০১৩: গুয়াতেমালা, হাইতি।
২০১২: থাইল্যান্ড।
২০১১: আন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, বেলিজ, ব্রাজিল, চিলে, ডোমিনিকা, এল সালভাদর, গ্রেনাডা, গায়ানা, হন্ডুরাস, আইসল্যান্ড, লেসোথো, লাইবেরিয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডিনস, দক্ষিণ সুদান, সুরিনাম, সিরিয়া, উরুগুয়ে।
২০১০: আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর।
২০০৯: ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ভেনেজুয়েলা।
২০০৮: কোস্টারিকা, আইভরি কোস্ট, লেবানন।
২০০৬: মন্টেনেগ্রো।
২০০৪: পূর্ব তিমুর।

১৯৯৮: মালাউই।
১৯৯৫: কিরগিজস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকা।
১৯৯৪: তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান।
১৯৯২: আজারবাইজান, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান।
১৯৯১: সোয়াজিল্যান্ড।
১৯৮৯: বেনিন, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, ফিলিপাইন, রুয়ান্ডা, ভানুয়াতু।
১৯৮৮: আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বেলারুশ, ভুটান, বতসোয়ানা, ব্রুনেই, বুলগেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, কেপ ভার্দে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, চাদ, চীন, কোমোরোস, কিউবা, সাইপ্রাস, গণতান্ত্রিক কঙ্গো, জিবুতি, মিসর, গ্যাবন, গাম্বিয়া, ঘানা, গিনি, গিনি-বিসাউ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লাওস, লিবিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মৌরিতানিয়া, মরিশাস, মঙ্গোলিয়া, মরক্কো, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, নেপাল, নিকারাগুয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, কাতার, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সার্বিয়া, রোমানিয়া, রাশিয়া, সাও টোমে ও প্রিন্সিপে, সৌদি আরব, সেনেগাল, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, স্লোভাকিয়া, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুদান, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, উগান্ডা, ইউক্রেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তানজানিয়া, ভিয়েতনাম, ইয়েমেন, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে।
সাম্প্রতিক স্বীকৃতি পরিকল্পনা
জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে: ফ্রান্স—সেপ্টেম্বরে স্বীকৃতি দেবে। ব্রিটেন—সেপ্টেম্বরের মধ্যে গাজা যুদ্ধবিরতিতে ইসরায়েল রাজি না হলে স্বীকৃতি দেবে। কানাডা—প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ওপর সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে। অস্ট্রেলিয়া—জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সেপ্টেম্বরে স্বীকৃতি দেবে।
এখন এই পদক্ষেপ কেন

বিশ্লেষকদের মতে, গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে পশ্চিমা মিত্রদের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু, দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মানবিক বিপর্যয়, অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, দখলকৃত ভূমি সংযুক্ত করার হুমকি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির সরাসরি বিরোধিতা নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।
স্বীকৃতির সম্ভাব্য প্রভাব
প্রতীকীভাবে এটি ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক বৈধতা বাড়াবে। বাস্তবে এটি কূটনৈতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াতে পারে, বাণিজ্য ও সহায়তায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং আলোচনায় ফিলিস্তিনের অবস্থান শক্তিশালী করবে। তবে শুধুমাত্র স্বীকৃতি পেলেই জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া যাবে না, কারণ এর জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন দরকার—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিতে পারে এবং অতীতে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন প্রধান বাধা
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। গত বছর ১২টি দেশ সমর্থন করলেও যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ প্রস্তাব ভেটো দেয়। ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ড ভোটে অংশ নেয়নি।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল এই স্বীকৃতি প্রচেষ্টাকে নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি হামাসের ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে পুরস্কৃত’ করছে। তাদের দাবি, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যেকোনো অগ্রগতি সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই হতে হবে, একতরফা কূটনৈতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে নয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















