চীনের বৈশ্বিক মানদণ্ড গড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা
চীন তাদের ওপেন সোর্স কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেলকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে রূপ দিতে চাইছে। এই প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তারা আশঙ্কা করছে, মার্কিন মডেলগুলো পিছিয়ে পড়তে পারে এবং এর ফলে চীন ভূরাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে।
ধারাবাহিক অগ্রগতি ও নতুন মডেলের উত্থান
২০২৫ সালের শুরু থেকে চীনের এআই খাতে ধারাবাহিক অগ্রগতি দেখা গেছে। জানুয়ারিতে আলোচিত ডিপসিক (DeepSeek) এবং এর আর১ (R1) রিজনিং মডেল প্রকাশের পর জুলাই থেকে আলিবাবার কুয়েন (Qwen), মুনশট, জেড.এআই ও মিনিম্যাক্সসহ একাধিক মডেল বাজারে এসেছে। এদের অনেক সংস্করণ ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত, যা ওপেন সোর্স বা ওপেন ওয়েট হিসেবে পরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও ওপেনএআই-এর পদক্ষেপ
যুক্তরাষ্ট্রের বড় এআই কোম্পানিগুলো এতদিন নিজেদের মডেল গোপন রেখেছিল। কিন্তু চীনের অগ্রগতির চাপে ওপেনএআই আগস্টের শুরুতে প্রথম ওপেন সোর্স মডেল ‘gpt-oss’ প্রকাশ করে। প্রযুক্তির ইতিহাস দেখায়, শুরুর প্রতিযোগিতায় থাকা অনেক কোম্পানি শেষে কয়েকটি প্রধান প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়—যেমন ডেস্কটপে উইন্ডোজ, সার্চে গুগল, মোবাইলে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড।

চীনের ওপেন সোর্স কৌশল ও মার্কিন উদ্বেগ
ওপেন সোর্স প্রযুক্তি সহজলভ্যতা ও নমনীয়তার কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাম্প প্রশাসন জুলাইয়ে প্রকাশিত এক পরিকল্পনায় সতর্ক করেছে যে, ওপেন সোর্স মডেল ব্যবসা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানদণ্ডে পরিণত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আমেরিকান মূল্যবোধে’ ভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় ওপেন মডেল তৈরির আহ্বান জানানো হয়।
অর্থনৈতিক লাভ বনাম দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ
ওপেন সোর্স মডেল তৈরি করতে শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় হলেও তা থেকে সরাসরি আয় হয় না। তবে যে কোম্পানি ব্যবহারকারীদের ধরে রাখতে পারবে, তারা অতিরিক্ত সেবা বিক্রির মাধ্যমে লাভ তুলতে পারে—যেমন গুগল অ্যান্ড্রয়েডের সঙ্গে সার্চ, ইউটিউবসহ অন্যান্য সেবা দেয়।
কৌশলগত কারণে ওপেন সোর্সে বিনিয়োগ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় চীন ওপেন সোর্স প্রকল্পগুলোকে কৌশলগত ‘ব্যাকআপ’ হিসেবে লালন করছে। শুধু এআই নয়, অপারেটিং সিস্টেম, সেমিকন্ডাক্টর আর্কিটেকচার ও ইঞ্জিনিয়ারিং সফটওয়্যারেও তারা একই নীতি অনুসরণ করছে।
ব্যবসায়িক ব্যবহার ও এশিয়ার অগ্রাধিকার
রাজনীতি ছাড়াও ওপেন সোর্স এআই মডেল ব্যবসায়িক খাতে জনপ্রিয় হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো নিজেদের সিস্টেমে বসিয়ে গোপনীয় তথ্য সুরক্ষিত রাখছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ওভারসি-চাইনিজ ব্যাংক ওপেন সোর্স মডেল দিয়ে প্রায় ৩০টি অভ্যন্তরীণ টুল তৈরি করেছে—যেমন গুগলের জেমা দিয়ে ডকুমেন্ট সারাংশ, কুয়েন দিয়ে কোড লেখা এবং ডিপসিক দিয়ে বাজার বিশ্লেষণ।

চীনা মডেলের ভাষাগত সুবিধা
গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্টিফিশিয়াল অ্যানালাইসিস জানায়, আলিবাবার কুয়েন৩ মডেল যুক্তরাষ্ট্রের ওপেনএআই-এর gpt-oss-কে পেছনে ফেলেছে, যদিও এটি আকারে প্রায় দ্বিগুণ বড়। অনেক এশীয় প্রকৌশলী মনে করেন, চীনা মডেল স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সূক্ষ্মতা বোঝায় এগিয়ে।
তীব্র প্রতিযোগিতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
চীনের এআই বাজারে শুরুতে বন্ধ মডেলের দামে প্রতিযোগিতা ছিল, যা এখন ওপেন সোর্স মডেলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এখন ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করার সুযোগ বেশি, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোই শেষ পর্যন্ত বড় ব্যবহারকারীভিত্তি কাজে লাগিয়ে লাভ তুলতে সক্ষম হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের ওপেন সোর্স এআই-এ অগ্রগতি শুধু প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলগত চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। এই প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত কয়েকটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, যারা বৈশ্বিক এআই মানদণ্ড নির্ধারণ করবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















