সীমান্তে ক্লান্ত মানুষের ঢল
প্রতিদিন সীমান্তে এসে পৌঁছাচ্ছেন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও আতঙ্কিত আফগান শরণার্থীরা। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করছে—হঠাৎ এই বিপুল ফেরতপ্রবাহ আফগানিস্তানে ভয়াবহ মানবিক সংকট ডেকে আনছে। সীমিত সম্পদের কারণে তাদের সহায়তা দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে, কারণ অনেকেরই পরিচয়পত্র নেই এবং তালেবান শাসনে তাদের অধিকারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে।
বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ঢল
হাজার হাজার আফগান শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ফিরে আসছে—অনেকেই বাধ্য হয়ে, কারও কারও কাছে আফগানিস্তান সম্পূর্ণ অজানা। অনেকে ফিরে এসে দেখছেন, তাদের বাড়ি-ঘর বা জীবিকা আর নেই। আগে যেসব প্রতিবেশী দেশ ছিল আশ্রয়ের জায়গা, এখন সেসব দেশেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, যা সংকটাপন্ন আফগানিস্তানকে আরও অনিশ্চিত অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র বাবর বালোচ জানিয়েছেন, চলতি বছরই ২১ লাখের বেশি আফগান দেশে ফিরেছেন বা ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ লাখ ইরান থেকে এবং ৩ লাখ ৫২ হাজারের বেশি পাকিস্তান থেকে। চার দশকের যুদ্ধ, দখল, অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক ধসের পর আফগানিস্তান এই চাপ সামলানোর মতো অবস্থায় নেই। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ও তালেবান শাসন ফিরে আসার পর দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, বিদেশি সাহায্য ও সম্পদ স্থগিত হয় এবং সরকারি সেবা প্রায় ভেঙে পড়ে।

আঞ্চলিক নীতি পরিবর্তন ও বহিষ্কার অভিযান
বালোচ বলেন, ইরান ও পাকিস্তান উভয় দেশই আফগানদের ফেরত পাঠাতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, না ফিরলে গ্রেপ্তার বা বহিষ্কারের হুমকি দিচ্ছে। মার্চে ইরান অবৈধ আফগানদের জন্য দেশ ছাড়ার সময়সীমা দেয়। জুনে পাকিস্তানও দ্বিতীয় দফা বহিষ্কার শুরু করে, বিশেষ করে নিবন্ধনবিহীনদের লক্ষ্য করে। পাকিস্তান বলছে, এটি শুধু ‘অবৈধ বিদেশিদের’ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইরানও নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চাপের কথা তুলে ধরে এ পদক্ষেপকে যুক্তিসঙ্গত বলছে।
তালেবান সরকারের প্রতিবাদ
আফগান শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক উপমন্ত্রী আবদুর রহমান রশিদ এ বহিষ্কারকে আন্তর্জাতিক আইন, মানবিক নীতি ও ইসলামি মূল্যবোধের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইতিহাসে এত ব্যাপক ও একযোগে শরণার্থী ফেরত আসা আফগানিস্তান আগে দেখেনি। সীমান্ত পেরোনোর পর তাদের সামনে অপেক্ষা করছে অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা ও নিরাপত্তাহীনতা।
ত্রাণ প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতা
বালোচ জানান, সীমান্তে ক্লান্ত ও আতঙ্কিত মানুষদের সহায়তা করা হচ্ছে—খাবার, জরুরি অর্থ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অর্থের সংকটের কারণে এই সহায়তা কয়েক সপ্তাহের বেশি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। অনেকেই বলছেন, তারা ফেরার সিদ্ধান্ত নিজেরা নেননি; জোরপূর্বক বা বাধ্য হয়ে ফিরেছেন। ফেরত আসা মানুষের অনেকের পরিচয়পত্র নেই, ফলে সহায়তা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

নারী ও শিশুদের জন্য চরম ঝুঁকি
বালোচ সতর্ক করেছেন, নথিপত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অভাব থেকে শুরু করে নতুন জীবিকা গড়ার পথে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন—তালেবান শাসনে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত বন্ধ, অধিকাংশ চাকরি নিষিদ্ধ, ফলে তাদের জীবনে প্রায় সম্পূর্ণ অদৃশ্যতা নেমে আসছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত রিচার্ড বেনেটও বলেছেন, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান ফেরত আসা মানুষের জন্য নিরাপদ নয়।
আন্তর্জাতিক সংলাপ ও সমাধানের আহ্বান
জাতিসংঘ মহাসচিবের আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রোজা ওতুনবায়েভা এই গণপ্রত্যাবর্তনকে “আমাদের মানবিকতার পরীক্ষা” হিসেবে উল্লেখ করে জরুরি ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার সমন্বিত পরিকল্পনার আহ্বান জানিয়েছেন। বালোচও ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে অর্থায়ন বাড়ানোর অনুরোধ জানান—যাতে সীমান্তে তাৎক্ষণিক সহায়তা ও দেশে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন সম্ভব হয়।
 
																			 সারাক্ষণ রিপোর্ট
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 


















