শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট
গোলাম মুস্তাফা ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাট্য জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৩৫ সালের ২ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ও শিল্পকলার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব তাঁকে সাহিত্য, আবৃত্তি ও অভিনয়ের জগতে টেনে এনেছিল।
শিল্পজগতে প্রবেশ
গোলাম মুস্তাফার শিল্পজীবন শুরু হয়েছিল মঞ্চ ও রেডিও নাটকের মাধ্যমে। স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের অন্যতম পরিচিত কণ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাঁর অভিনীত নাটকগুলোতে কণ্ঠ, সংলাপ এবং আবেগের গভীর প্রকাশ তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

চলচ্চিত্র জীবন
ষাট ও সত্তরের দশকে গোলাম মুস্তাফা চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। তিনি সাধারণত চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করলেও, তাঁর অভিনয় প্রতিটি চরিত্রে গভীরতা ও বাস্তবতার ছাপ রাখত। তিনি সূর্য দীঘল বাড়ি, সারেং বউ, দহন, অলাতচক্রসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোতে দর্শকরা পেতেন মানবিকতার ছোঁয়া, বাস্তব জীবনসংঘাতের প্রতিচ্ছবি এবং আবেগঘন সংলাপ।
তাঁর অভিনীত আরও উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে সোনার কাঁচি, দুই নয়নের আলো, দীপু নাম্বার টু, মহানায়ক, চোরাবালি, সন্ধি,
টেলিভিশন ও মঞ্চে অবদান
গোলাম মুস্তাফা শুধু চলচ্চিত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং টেলিভিশন নাটক ও মঞ্চ নাটকেও সমানভাবে সফল হন। টেলিভিশনের সোনালি যুগে তাঁর অভিনীত নাটকগুলো দর্শকদের মনে আজও স্মৃতিময় হয়ে আছে। বিশেষ করে আবৃত্তির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অনন্য নাম। তাঁর কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি ছিল হৃদয়গ্রাহী ও অনন্যসাধারণ।

আবৃত্তি শিল্পে অবদান
তিনি শুধু একজন অভিনেতাই নন, বরং আবৃত্তি শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ। কবিতাকে আবৃত্তির মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলার ক্ষমতা তাঁর কণ্ঠে ছিল অসাধারণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আবেগপূর্ণ ভালোবাসা তাঁকে শিল্পের উচ্চতম আসনে নিয়ে যায়।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
অভিনয় ও শিল্পকলায় অসামান্য অবদানের জন্য গোলাম মুস্তাফা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যে প্রজন্ম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে গড়ে তুলতে অসামান্য অবদান রেখেছে।
ব্যক্তিজীবন ও উত্তরাধিকার

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সাদাসিধে ও নীতিনিষ্ঠ মানুষ। তিনি বিবাহিত জীবনেও ছিলেন সফল। তাঁর স্ত্রী শিরিন মুস্তাফা ছিলেন গৃহিণী, যিনি সংসারে এবং সন্তানদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের সংসারে তিন মেয়ে, যাদের মধ্যে সুবর্ণা মুস্তাফা বাংলাদেশের অভিনয় জগতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যা প্রমাণ করে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
প্রয়াণ ও স্মৃতি
১৯৯৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গোলাম মুস্তাফা প্রয়াত হন। তবে তাঁর জীবন ও কর্ম আজও বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর আবৃত্তি, নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় আজও দর্শক ও শ্রোতাদের মনে এক গভীর ছাপ রেখে যায়।
অতিরিক্ত তথ্য ও বিশ্লেষণ
অভিনয়ের ধরন
গোলাম মুস্তাফা চরিত্রাভিনয়ে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, তিনি নায়ক না হয়েও দর্শকদের মন জয় করতে পারতেন। গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, পরিমিত অঙ্গভঙ্গি এবং সংলাপ পরিবেশনে তাঁর দক্ষতা তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল।

সমকালীন শিল্পীদের মূল্যায়ন
সমসাময়িক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁকে ‘অভিনয় বিদ্যালয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুবর্ণা মুস্তাফা এক সাক্ষাৎকারে বলেন—“আমার বাবাকে দেখে আমি শিখেছি শিল্পী হওয়ার মানে শুধু অভিনয় নয়, বরং সততা ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলা।”
সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে অবদান
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প যখন নতুন করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখন গোলাম মুস্তাফার মতো শিল্পীরা ছিলেন ভরসার জায়গা। তিনি দেশপ্রেম, মানবতা এবং নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে।
উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা
শুধু তাঁর পরিবার নয়, আজকের প্রজন্মের শিল্পীরাও তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখে। নাটক ও চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীরা এখনও তাঁর কাজকে পাঠ্যরূপে অধ্যয়ন করে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















